সঙ্গীত কিংবদন্তী হযরত আমির খসরু...
আমার দূর্ভাগ্য যে আমার বাবা আমার নানার বাড়ীতে বিয়ে করেন !! আর আমার নানার বাড়ীটাও এতোই কাছে যে একটা ক্যান্ডি মুখে দিয়ে দুটো কামড় বসানোর আগেই নানার বাড়ীতে পৌছা যায় ! ঢাকায় যারা বসবাস করেন তাদের পায়ে কোন সমস্যা না থাকলেও মনের মধ্য একটা সমস্যা সব সময় বিরাজ করে আর তা হচ্ছে অতি রিক্সা ভক্তি ! কিন্তু আমার বাড়ী থেকে আমার নানা বাড়ী যেতে অতি রিক্সা ভক্ত কেউও রিক্সা নিতে চাইবেনা। নিকট আত্মীয়দের বাড়ীও এমন অবস্থানের মধ্যে যেখানে যেতে ঘড়ির মিনিটের কাঁটাটাকেও ভালো মত দুইটা চক্কর দিতে দেয়না। যে কারণে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি আর পরিবেশের ছোঁয়া পেতে আমাকে বেশ কিছু সময় খরচ করতে হয় জীবনের বেঁধে দেয়া সময় থেকে। কিন্তু আমার এই দূর্ভাগ্য থেকে পুরোটাই মুক্ত ছিলেন তুর্কীতে জন্ম নেয়া সংগীত কিংবদন্তী হযরত আমির খসরু।
তুর্কী সম্রাট ইলতুতমিসের অধীনে জায়গীরদার আমির সাইফুদ্দিন মাহমুদ এর ঘরে ১২৫৩/৫৪ সালে হযরত আমির খসরু জন্ম গ্রহণ করেন। হযরত আমির খসরুর মা বিবি জোলায়খা ছিলেন দিল্লীর রাজ-দরবারের একজন আমত্যের কন্যা। এই খানেই আমার ভাগ্যের সাথে হযরত আমির খসরুর বেমিল ছিলো বলেই বাবা-মায়ের কল্যাণে তিনি ছিলেন পারস্য ও ভারতীয় গুনের অধিকারী সেই জন্মলগ্ন থেকেই। পৃথিবীতে যত মহান সঙ্গীতজ্ঞ জন্ম গ্রহণ করেছেন আমির খসরু ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন। যৌবনে তিনি ছিলেন আলাউদ্দিন খলজীর সভা গায়ক, ধীরে ধীরে একজন বড় মাপের কবিও হয়ে উঠেন; রচনা করেন এক লক্ষেরও বেশী কবিতা!
আমির খসরু পারস্য ও ভারতীয় সংগীতের এক অপূর্ব সম্মীলন ঘটিয়েছিলেন। বছরের পর বছর পারস্য ও ভারতীয় সংগীত নিয়ে গবেষণা করে সংগীতের থিওরীতে অগাধ জ্ঞান লাভ করেন। সেই সাথে সঙ্গীত পরিবেশনেও তৎকালীন সময়ের তার কোন জুড়ি ছিলো না। তিনি সংগীত সাধনা করে সংগীতে আনেন বিপ্লব, দিলেন নতুন রূপ। সৃষ্টি করেছেন বহু রাগ রাগিনীর; তারমধ্যে ইমন, কাফি, জিলাফ, বাহার ও সাজগিরি উল্লেখযোগ্য। দিল্লীর বিখ্যাত আউলিয়া হযরত নিজামুদ্দিনের শিষ্যত্বও লাভ করেন। হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া তাঁকে খুব ভালোবাসাতেন এবং তাঁরই প্রেরণায় তিনি "কাওয়াল" নামক এক প্রকার গানের প্রচলন করেন। সামাৎ ও নিয়াজ নামে তাঁর দুই শিষ্য ছিলো, তারা এই কাওয়াল গান গেয়ে বেশ পরিচিতি লাভ করে। আজও কাওয়াল গানে সামাৎ ও নিয়াজ অবিস্মরণীয় দুটি নাম। এই কাওয়াল থেকেই ধীরে ধীরে হামদ ও নাত গানের সৃষ্টি।
আমির খসরু অনেক ধরনের গান পরিবেশন করতে পারতেন, তার মধ্যে কলবানা, নকশ, নিগার, গুল, হাওয়া, বাসিত, তিলানা, তারানা ও সুহিলা উল্লেখযোগ্য। তিনি সতের রকমেরও বেশী তাল সৃষ্টি করেন সেগুলো হলোঃ খামসা, সাওয়ারী, ফিরদস্ত, জত, পুশতো আরা, চৌতাল, সুরফাক্তা, ঝুমরা ইত্যাদি। শুধু তাই নয় আমির খসরু কয়েক রকমের বাদ্য যন্ত্রও আবিষ্কার করে গেছেন। আজকের যুগের অতি জনপ্রিয় "সেতার" বাদ্যযন্ত্রটি তারই আবিষ্কৃত বাদ্যযন্ত্রগুলোর একটি। আমির খসরুর আবিষ্কৃত সেতার যন্ত্রটিতে আগে তিনটি তার ব্যবহৃত হতো। পারস্যতে 'সে' মানে তিন, তাই তিনটি তারের কারণে তিনি সদ্য আবিষ্কৃত যন্ত্রটির নামকরণ করেন "সেতার" নামে। বর্তমানে অবশ্য সেতারে তিননের অধিক তার ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি পাখোয়াজ নামক একটি যন্ত্র দু'ভাগে ভাগ করে "তবলা ও বাঁয়ার" সৃষ্টি করেন। আমির খসরু হলেন সংগীতে মুসলমান গীতির প্রবর্তক। ফার্সী সংগীতেও তাঁর অগাধ জ্ঞান ছিলো। সনাতনপন্থী উপমহাদেশীয় সংগীতকে তিনি মুক্ত করে আধুনিক ধারার সংগীতে রূপদান করেন। তাঁর সময় থেকেই সংগীতে নতুন এক যুগের প্রবর্তন হয়।
আমির খসরুকে সংগীতে "নায়ক" উপাধীতে ভূষিত করা হয়েছিলো। সেই সময়ে যে সংগীতজ্ঞ থিওরী ও ব্যবহারিক সংগীতে অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় দিতেন তাঁদেরকেই কেবল নায়ক উপাধীতে ভূষিত করা হতো। আমির খসরু এই দুই গুনেরই অধিকারী ছিলেন। তাই তিনি ছিলেন "নায়ক" এবং প্রথম মুসলিম "নায়ক"। এই কলি যুগে যারা সংগীত নিয়ে নাড়া চাড়া করেন তাদের অনেকেই হয়তো আমির খসরুকে চিনেন না বা নামও শুনেন নাই। কিন্তু তাতে কি, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় সেদিনের সেই আমির খসরু যদি সংগীতজ্ঞ না হয়ে আর দশ জন সাধারণের মতো হতেন তবে আজকের এই আধুনিক সংগীতের গতিটাই হয়তো পাল্টে যেতো ! কিংবদন্তী হযরত আমির খসরু সংগীতের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থাকবেন সংগীতের আকাশে যতদিন সংগীত ঠিকে থাকবে পৃথিবীর বুকে।
জবরুল আলম সুমন
সিলেট।
২১শে অক্টোবর, ২০১০ খৃষ্টাব্দ।
তুর্কী সম্রাট ইলতুতমিসের অধীনে জায়গীরদার আমির সাইফুদ্দিন মাহমুদ এর ঘরে ১২৫৩/৫৪ সালে হযরত আমির খসরু জন্ম গ্রহণ করেন। হযরত আমির খসরুর মা বিবি জোলায়খা ছিলেন দিল্লীর রাজ-দরবারের একজন আমত্যের কন্যা। এই খানেই আমার ভাগ্যের সাথে হযরত আমির খসরুর বেমিল ছিলো বলেই বাবা-মায়ের কল্যাণে তিনি ছিলেন পারস্য ও ভারতীয় গুনের অধিকারী সেই জন্মলগ্ন থেকেই। পৃথিবীতে যত মহান সঙ্গীতজ্ঞ জন্ম গ্রহণ করেছেন আমির খসরু ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন। যৌবনে তিনি ছিলেন আলাউদ্দিন খলজীর সভা গায়ক, ধীরে ধীরে একজন বড় মাপের কবিও হয়ে উঠেন; রচনা করেন এক লক্ষেরও বেশী কবিতা!
আমির খসরু পারস্য ও ভারতীয় সংগীতের এক অপূর্ব সম্মীলন ঘটিয়েছিলেন। বছরের পর বছর পারস্য ও ভারতীয় সংগীত নিয়ে গবেষণা করে সংগীতের থিওরীতে অগাধ জ্ঞান লাভ করেন। সেই সাথে সঙ্গীত পরিবেশনেও তৎকালীন সময়ের তার কোন জুড়ি ছিলো না। তিনি সংগীত সাধনা করে সংগীতে আনেন বিপ্লব, দিলেন নতুন রূপ। সৃষ্টি করেছেন বহু রাগ রাগিনীর; তারমধ্যে ইমন, কাফি, জিলাফ, বাহার ও সাজগিরি উল্লেখযোগ্য। দিল্লীর বিখ্যাত আউলিয়া হযরত নিজামুদ্দিনের শিষ্যত্বও লাভ করেন। হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া তাঁকে খুব ভালোবাসাতেন এবং তাঁরই প্রেরণায় তিনি "কাওয়াল" নামক এক প্রকার গানের প্রচলন করেন। সামাৎ ও নিয়াজ নামে তাঁর দুই শিষ্য ছিলো, তারা এই কাওয়াল গান গেয়ে বেশ পরিচিতি লাভ করে। আজও কাওয়াল গানে সামাৎ ও নিয়াজ অবিস্মরণীয় দুটি নাম। এই কাওয়াল থেকেই ধীরে ধীরে হামদ ও নাত গানের সৃষ্টি।
আমির খসরু অনেক ধরনের গান পরিবেশন করতে পারতেন, তার মধ্যে কলবানা, নকশ, নিগার, গুল, হাওয়া, বাসিত, তিলানা, তারানা ও সুহিলা উল্লেখযোগ্য। তিনি সতের রকমেরও বেশী তাল সৃষ্টি করেন সেগুলো হলোঃ খামসা, সাওয়ারী, ফিরদস্ত, জত, পুশতো আরা, চৌতাল, সুরফাক্তা, ঝুমরা ইত্যাদি। শুধু তাই নয় আমির খসরু কয়েক রকমের বাদ্য যন্ত্রও আবিষ্কার করে গেছেন। আজকের যুগের অতি জনপ্রিয় "সেতার" বাদ্যযন্ত্রটি তারই আবিষ্কৃত বাদ্যযন্ত্রগুলোর একটি। আমির খসরুর আবিষ্কৃত সেতার যন্ত্রটিতে আগে তিনটি তার ব্যবহৃত হতো। পারস্যতে 'সে' মানে তিন, তাই তিনটি তারের কারণে তিনি সদ্য আবিষ্কৃত যন্ত্রটির নামকরণ করেন "সেতার" নামে। বর্তমানে অবশ্য সেতারে তিননের অধিক তার ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি পাখোয়াজ নামক একটি যন্ত্র দু'ভাগে ভাগ করে "তবলা ও বাঁয়ার" সৃষ্টি করেন। আমির খসরু হলেন সংগীতে মুসলমান গীতির প্রবর্তক। ফার্সী সংগীতেও তাঁর অগাধ জ্ঞান ছিলো। সনাতনপন্থী উপমহাদেশীয় সংগীতকে তিনি মুক্ত করে আধুনিক ধারার সংগীতে রূপদান করেন। তাঁর সময় থেকেই সংগীতে নতুন এক যুগের প্রবর্তন হয়।
আমির খসরুকে সংগীতে "নায়ক" উপাধীতে ভূষিত করা হয়েছিলো। সেই সময়ে যে সংগীতজ্ঞ থিওরী ও ব্যবহারিক সংগীতে অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় দিতেন তাঁদেরকেই কেবল নায়ক উপাধীতে ভূষিত করা হতো। আমির খসরু এই দুই গুনেরই অধিকারী ছিলেন। তাই তিনি ছিলেন "নায়ক" এবং প্রথম মুসলিম "নায়ক"। এই কলি যুগে যারা সংগীত নিয়ে নাড়া চাড়া করেন তাদের অনেকেই হয়তো আমির খসরুকে চিনেন না বা নামও শুনেন নাই। কিন্তু তাতে কি, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় সেদিনের সেই আমির খসরু যদি সংগীতজ্ঞ না হয়ে আর দশ জন সাধারণের মতো হতেন তবে আজকের এই আধুনিক সংগীতের গতিটাই হয়তো পাল্টে যেতো ! কিংবদন্তী হযরত আমির খসরু সংগীতের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থাকবেন সংগীতের আকাশে যতদিন সংগীত ঠিকে থাকবে পৃথিবীর বুকে।
জবরুল আলম সুমন
সিলেট।
২১শে অক্টোবর, ২০১০ খৃষ্টাব্দ।
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন