বৈশাখ এবং আমি

আমি কোন পেশাদার লেখক নই, টুকটাক যা লেখা হয় তা নিতান্তই শখের বসে। তাই বিশেষ কোন উপলক্ষ্যে পেশাদার লেখকদের মতো আমাকেও যে লিখতে হবে এমন কোন কথা নেই। তবুও মাঝে মধ্যে যেহেতু একটু আধটু লেখা হয় তাতেই আমার কিছু ভালো শুভাকাঙ্ক্ষী জুটে যায় এবং তাদের আবদার মেটাতে গিয়ে এখন মাথার চুল ছিঁড়ি। গত দু-তিন দিন থেকে আমার হাতের আঙ্গুলে গুনা ক'জন শুভাকাঙ্ক্ষী বারবার তাগাদা দিচ্ছিলো নব বর্ষ নিয়ে নতুন মাল ডেলিভারী দেবার জন্য কিন্তু তাদেরকে বুঝানো অসম্ভব যে প্রোডাকশন না হলে ডেলিভারী দেবো কিভাবে ? তাই গত বছরের পুরানা মাল সাপ্লাই দিয়ে সটকে পড়তে চাইছিলাম কিন্তু সটকে পড়তে গিয়ে আরো শক্ত ভাবেই আটকে গেলাম !! কিন্তু আমাকে আটকে থাকলে চলবে না উদ্ধার হতে হবে। নিজেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে পহেলা বৈশাখ সম্পর্কিত কিছু রীতি রেওয়াজ নিয়ে ভাবতে লাগলাম, ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করেই মাথার ভেতর লেখার একটা উপাদান মিলে গেলো। সাথে সাথে কম্পিউটার অন করে লিখতে বসলাম...

শিরোনাম দিলাম "পান্তা বিলাস" সংস্কার বলুন আর কু-সংস্কার বলুন আমাদের অনেকেরই ধারণা বছরের প্রথম দিন যা হবে তার রেশ সারা বছর জুড়ে থাকবে। তাইতো সবাই এই দিনটাকে একটু আরামের সাথে আনন্দের সাথে কাটাতে চায়। পহেলা বৈশাখ এলেই বাঙ্গালীরা পান্তা ভাতের উপর জবর দখল শুরু করে দেয় এ আর নতুন কিছু নয় কিন্তু বছরের প্রথম দিন যদি পান্তা দিয়ে শুরু হয় তবে ত সারা বছর জুড়েই পান্তার ঘানি টানতে হবে। আমরা এদিন কি কোরমা পোলাও বা আরোও ভালো মন্দ কিছু খেতে পারিনা ? এসব উদ্ভট প্রশ্ন ও উত্তর আর নিজের সাথেই যুক্তি তর্ক খেলে লেখা নিয়ে এগুচ্ছিলাম। প্রায় অর্ধেক এর মতো লেখা শেষ করে হঠাৎ মনে হলো নাহ বাঙালীর কোন উৎসব নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করা ঠিক হবেনা। পাবলিক ক্ষেপে গেলে অত সহজে সামাল দেয়া যায়না। আমি ছেড়েই দিলাম, কিন্তু ছেড়ে দিলে কি আর হবে ? নতুন কিছু নিয়ে ভাবতে হবে যাতে সাপ মরবে আবার লাঠিও ভাংবেনা।

আজ সকালে ঘুম থেকে উঠার পর অনেক প্রিয়জনই ফোন করেছেন, মুঠো বার্তায় শুভেচ্ছা পাঠিয়েছেন পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে। আমার এক বন্ধু বাংলায় মুঠো বার্তা পাঠিয়েছে। কিন্তু আমার মুঠো ফোনে বাংলা ফন্ট সমর্থন করেনা বলে অক্ষরগুলি বাক্স বাক্স মনে হলো। বার্তাটির মর্ম উদ্ধারের জন্য তাকে ফোন দিলাম কিন্তু সে ফোন ধরছেনা। আবারো ফোন দিলাম ধরছেনা ধরছেনা... হঠাৎ করেই লক্ষ্য করলাম তার মোবাইলে "এসো হে বৈশাখ" ওয়েলকাম টিউন লাগানো, সেটাই বাজছে। আমার আর বুঝতে বাকি রইলোনা কে সে আমার ফোন ধরেনি। আমার এই বন্ধুকে আমরা বিদেশি বন্ধু বলে ক্ষেপানোর চেষ্টা করি কিন্তু সে ক্ষেপেনা বরং সেটাই তার শুনতে ভালো লাগে। তার মতে দেশের কোন কিছুই যুৎসই নয়। তার পরিধেয় বস্ত্র থেকে শুরু করে তার ব্যবহৃত সব কিছুই বিদেশী। মোবাইলের ওয়েলকাম টিউনেও বাজতো কোন হিন্দি অথবা ইংরেজী গানের অংশ বিশেষ। বাজারে কোন কিছু কেনা কাটা করতে গেলেই আগে জিজ্ঞেস করবে এটা দেশি নাকি বিদেশি। অবশ্য এক্ষেত্রে তাকেও দোষ দিয়ে লাভ নেই এখন দোকানের সেলস ম্যানেরাও তাদের দোকানের সব কিছুকেই বিদেশি বলেই ক্রেতার হাতে ধরিয়ে দেয়। তাদের ভাবটা এমন যে স্বদেশী কোন পণ্যই যথাযত মানের নয়।
 কিছু দিন আগেও আমি একটা জুতোর দোকানে গেলাম জুতা কিনতে, আমি যে জুতোর উপরেই চোখ রাখি জুতা বিশেষজ্ঞ সেই সেলস ম্যানকে কোন কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে জানিয়ে দেয় যে সেটা ইটালিয়ান, ওটা থাইল্যান্ডের ওটা কোরিয়ার ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি তার কথায় কান দিইনি কারণ আমার সেলস ম্যান বিষয়ক একটা কৌতুক মনে পড়ে গেলো, কোন এক ভদ্র মহিলার স্বামী মারা গেছেন তিনি তার মৃত স্বামীর জন্য কাফনের কাপড় কিনতে গেলে এক সেলস ম্যান ঐ ভদ্র মহিলাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে কাফনের কাপড়ের বদলে এক পিস স্যুটের কাপড় ধরিয়ে দেয় !! আমি আর কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে পড়ি। আমার সেই বিদেশি বন্ধুটি আমাকে কল ব্যাক করে জানালো সে কিছুক্ষণের মধ্যে আমার বাসায় আসছে আমাকে নিয়ে বৈশাখী মেলায় যাবে। আমি হ্যা না কিছু না বলেই ফোনটা কেটে দিলাম কারণ ভিড় জটলা আমার একদম পছন্দের না। এরচে আমি বাসায় আরাম করে শুয়ে থাকতে অনেক বেশি পছন্দ করি অবশ্য এজন্য আমার প্রিয়জনদের কাছ থেকে আমাকে কম কথা শুনতে হয়নি। আমি তার ফোনটা ছেড়ে শুয়েই আছি, শুয়ে শুয়ে দেশ নিয়ে ভাবছি। যদিও আমি দেশ নিয়ে প্রায় ভাবি কিন্তু ভাবনার প্রতিফলন ব্যবহারিক জীবনে কখনোই প্রকাশ পায়না। আমরা সব সময় ব্যক্তি স্বার্থকেই প্রধান্য দিয়ে থাকি।

আমার পরিচিত একজন প্রায়ই কারণে অকারণে আমেরিকাকে গালি গালাজ করে থাকেন। তার মতে আমেরিকা পৃথিবীটাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, আফগানিস্থানের মতো এতো সুন্দর একটা দেশকেও ধ্বংস করে দিলো!! তিনি যদি একবার আফগানিস্থান যেতে পারতেন তাহলে সব গুলো মার্কিন সেনাকে নরকে পাঠাতেন ইত্যাদি। হঠাৎ একদিন আমি তাকে প্রসংঙ্গ ক্রমে জিজ্ঞেস করি ধরুন আমার হাতে এমন এক ক্ষমতা আছে যে ক্ষমতা দিয়ে আমি চাইলেই আপনাকে আমেরিকা আফগানিস্থান অথবা বাংলাদেশ স্থায়ী করে দিতে পারি, আমি যদি আপনাকে এই তিন দেশের কোন এক দেশে স্থায়ী বাসিন্দা করে দিতে চাই তাহলে আপনি কোন দেশ বেছে নিবেন ? তিনি কোন ভাবনা চিন্তা না করেই সোজা উত্তর দিলেন আমেরিকা। আমি পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লাম আপনি ত আমেরিকা পছন্দ করেন না তাহলে আমেরিকা যেতে চাইছেন কেন ? তিনি মুচকি হেসে জানালেন আমেরিকাকে আমি গালি দিই বিদেশিদের প্রতি তাদের উগ্র আচরণের কারনে কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে বললে বলবো আমেরিকার মতো স্বপ্নের দেশ আর একটাও এই পৃথিবীতে নেই। আমি আর অহেতুক তর্কে জড়ালাম না। কারণ কথায় আর কাজে যাদের মিল নেই তাদের সাথে তর্ক করার কোন মানে হয়না। আমার পরিচিত এক মৌ-লোভী মৌলভী আছেন যিনি একটা মাদ্রাসার শিক্ষক, নাচ গানের বিপরীতে তার শক্ত অবস্থান হলেও তার বাসার টেলিভিশনে ডিশের ক্যাবল সংযুক্ত। আমি একদিন তাকে কথাচ্ছলে জিজ্ঞেস করি গান বাজনা হারাম তা আপনি প্রায় বলে থাকেন অথচ আপনার ঘরে ডিশের কানেকশন কেন ? তিনি কিছুটা বিব্রত হলেও জবাবে বলেন আমি ত খবরই দেখি বেশির ভাগ সময় তবে মাঝে মধ্যে দু একটা নাচ গান না দেখলে আমি কিভাবে বুঝবো যে গানের মধ্যে খারাপ জিনিষ আছে আর মানুষকেই বা কিভাবে বুঝাবো। আমি তার যুক্তির কাছে হেরে যাই। আমি হেরে গিয়েও জয়ের স্বাদ নিই। হারের মাঝেও এক প্রকার আনন্দ আছে।

আমার দরজায় ঠক ঠক করে শব্দ হচ্ছে শুনে অলস শরীরটা নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। দরজা খুলতেই দেখি আমার সেই বন্ধুটি হাজির। পাজামা-পাঞ্জাবী পরা আমার এই বন্ধুকে যেন চেনাই যাচ্ছেনা, তাকে এর আগে কখনো পাজামা-পাঞ্জাবী পরা অবস্থায় দেখিনি। তার উপর গালে সারা মুখে রঙ দিয়ে শুভ নববর্ষ-১৪১৮ সহ নানান ফুল এঁকে ভরে ফেলেছে। আমাকে দেখে বললো আমি এখনো তৈরী হইনি কেন। আমি তাকে বুঝালাম আমার শরীরটা ভালো লাগছেনা মনটাও খুব একটা ভালো নেই, তুই ঘুরে আয় আমি সন্ধ্যার দিকে বের হবো। সে আমার কথা শুনে নিরানন্দ মনে বেরিয়ে গেলো। বৈশাখী মেলায় গিয়ে একদিনের জন্য বাঙ্গালী সেজে পান্তা খেয়ে ভন্ডামি করতে ইচ্ছে করলো না বলে আমি আবারো বিছানায় শুয়ে পড়লাম...

জবরুল আলম সুমন
সিলেট।
বিকেল ৫:২৫ মিনিট
১লা বৈশাখ, ১৪১৮ বাংলা
১৪ই এপ্রিল, ২০১১ খৃষ্টাব্দ।

0 মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পোস্ট পুরাতন পোস্ট হোম

    আমার ব্লগে আপনাকে স্বাগতম

    নিজের লেখা দিয়ে নিজের মতো করে এই ব্লগটি সাজানোর চেষ্টা করেছি, আমার এই ব্লগটি যদি আপনাদের ভালো লাগে তবেই আমার এই শ্রম স্বার্থক হবে। ব্লগটি পরিদর্শন করার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

ব্লগটি আজ দেখা হয়েছে মোট

ইতিহাসের এই দিনে

Flickr Images

2014 © জবরুল আলম সুমন কর্তৃক. Blogger দ্বারা পরিচালিত.

এক ঝলকে আমি

আমার ফটো
নিজের সম্পর্কে বলার মত সঞ্চয় আমার নেই। নিজেকে স্বচ্ছ আয়নার মতই ভাবি, আমার প্রিয় বন্ধুরা যখন আমার সামনে এসে দাঁড়ায় আমি তখন তাদের প্রতিবিম্ব মাত্র। তাতেই আমার সুখ। গান শুনতে পছন্দ করি, পছন্দ করি লিখতে আর সময় সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ি অচেনা পৃথিবীটাকে চেনার জন্য।

এই ব্লগটি সন্ধান করুন


Recent Comments