৩৩ দিনের ভালোবাসা !!
"সুমন এই পৃথিবী থাকবে যতদিন তোমাকে ভালোবেসে যাবো ৩৩ দিন !!!" খুবই হাস্যকর একটা ব্যপার। এর কোন মানে হয়না। কারো কারো কাছে হয়তো ব্যপারটা খুবই হাস্যকর ঠেকতে পারে কিংবা মূল্যহীন হতে পারে কিন্তু আমার কাছে এই লাইনটা বা এই কথা গুলো জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জনের একটা। তাহলে মূল প্রসংগে যাওয়া যাক। ১৯৯৫ সালের মাঝা মাঝিতে প্রথমবারের মতো একা একা কাউকে কিছু না বলে হুট হাট করে ঢাকায় চলে আসি। উদ্দেশ্য বাংলাদেশের পপ সম্রাট আজম খানের সাথে দেখা করা। তখন আমি আজম খানের এতোই অন্ধ ভক্ত ছিলাম যে আজম খানের প্রতিটি গানের লাইন আমার কন্ঠস্থ। এদিকে বাড়ীতে আমার খোঁজে হাউ কাউ শুরু হয়ে গেলো। তখন আমি মাত্র ১৫ বছরে এক দুরন্ত বালক ছিলাম বলেই বিভিন্ন জন বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করতে লাগলো, কেউ বলল ছেলে ধরা নিয়ে গেছে কেউ কেউ বলল কারো সাথে দুষ্টুমি (সে সময়ে আমি দুষ্টুমিতে চ্যাম্পিয়ন ছিলাম) করার জন্য হয়তো আমাকে মেরে ফেলেছে। আরোও অনেক রকমের মন্তব্য।
এখনকার মত তড়িৎ যোগাযোগের অত সুযোগ ছিলোনা বলে তাৎক্ষণিক ভাবে কারো সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হতো না। তখনো আমাদের বাসায় টেলিফোন লাইন আসেনি। আমাদের বেশীর ভাগ আত্মীয় স্বজন দেশের বাইরে থাকলেও তাদের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিলো চিঠি-পত্র ও আশপাশের লোকজন আসা যাওয়ার মাধ্যমে খবর আদান-প্রদান করা হতো। কাউকে কিছু না জানিয়ে আসায় আমি মোটেও চিন্তিত নই বরং আমি প্রচন্ড রকমের বিরক্ত ট্রেনের এক ঘেয়েমি টাইপের কুৎসিত শব্দ শুনতে শুনতে। আমার যেন সময় কাটছেনা। কখন ট্রেনটা ঢাকায় পৌছাবে, কখন আজম খানের সাথে দেখা হবে কিংবা আদৌ দেখা হবে কি না। সিলেট থেকে রাত ১০টায় ছেড়ে আসা উপবন ট্রেন সকাল ৭টায় ঢাকায় পৌছালো। আমি হাত ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে হাঁটা শুরু করে দিলাম আর মনে মনে গন্তব্য ঠিক করতে লাগলাম। কিন্তু কোথায় যাবো, কোথায় উঠবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কারণ আমি এর আগেও একাধিকবার ঢাকায় এলেও তা আব্বুর মধ্যমা আঙ্গুল আমাকে আমার গন্তব্যে পৌছে দিতো। আগে ঢাকার কাপ্তান বাজারে হোটেল বিলাস নামে আমাদের একটা আবাসিক হোটেল ছিলো। আব্বু আর বড় চাচা মিলে সেটা চালাত। তাই আমরা ঢাকায় বেড়াতে বা কাজে এলে আমাদের হোটেলে উঠতাম সেটাও প্রায় বছর পাঁচেক আগে বিক্রি করে দিয়ে বড় চাচা চলে গেলো আমেরিকায় আর আব্বু চলে গেলো লন্ডনে। তাহলে এখন আমি কোথায় উঠবো ? আমাদের নিকট আত্মীয়দের মধ্যে তেমন কেউ ঢাকায় থাকেনা, টুকটাক যারা আছেন তাদের কারো বাসার ঠিকানা আমি জানিনা।
কিছুটা ভয় ভয় লাগছে যদি অনাকাংখিত কোন ঘটনা ঘটে তাহলে কি করবো ? ঢাকার রাস্তা ঘাট কিছুই চিনিনা। একটা রিক্সায় চেপে বসলাম, রিক্সাওয়ালা জিজ্ঞেস করলো কোথায় যাবো আমি কোন কিছু না ভেবেই বলে দিলাম মগ বাজারে যাবো। তখন কোন বিশেষ একটা কারণে মগ বাজার নামটার সাথে খুব পরিচিত ছিলাম। (পত্রিকার পাতায় প্রায় পড়তাম মগবাজারের অমুক ষ্টুডিওতে তমুক শিল্পীর গান ধারণ করা হচ্ছে)। রিক্সার তিনটা চাকা সমানে চলছে সেই সাথে চলছে আমার ভয়ার্ত ভাবনারা। বিভিন্ন দোকানের সাইনবোর্ড দেখেই টের পেলাম মগবাজার চলে এসেছি। মগবাজারের চৌরাস্তার পাশে রিক্সাওয়ালা আমাকে নামিয়ে দিলো। পাশের একটা রেষ্টুরেন্টে নাস্তা সেরে থাকার জন্য হোটেল খুজতে লাগলাম অল্প সময়ের মধ্যেই পেয়ে গেলাম বেশ কিছু আবাসিক হোটেল। তার মধ্য একটাতে উঠে গেলাম। হোটেলে উঠে ফ্রেশ হয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম আজম খানের ঠিকানা যোগাড় করার জন্য। একটা দোকানে ঢুকলাম জুস কিনতে আমার ভাষার মধ্যে সিলেটি ভাষা মিশ্রণ দেখেই সে বুঝে নিলো আমি সিলেট থেকে এসেছি। দোকানী ছেলেটা আমার সাথে খাতির জমানোর চেষ্টা করলে নিজেই আরো এক ধাপ বাড়িয়ে তার সাথে কথা বলা শুরু করি। আমার উদ্দেশ্য ছিলো তার মাধ্যমে কোন একটা রেকর্ডিং ষ্টুডিওর ঠিকানা বের করা। আমি উদ্দেশ্যে সফল হলাম। তার মাধ্যমেই পেয়ে গেলাম শ্রুতি অডিও রেকর্ডিং ষ্টুডিওর ঠিকানা। আমি তখন কাল ক্ষেপন না করে পা বাড়ালাম শ্রুতি রেকর্ডিং ষ্টুডিওর উদ্দেশ্যে।
শ্রুতির দরজায় নক করতেই একজন ভূড়িওয়ালা লোক দরজা খুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো কাকে চাই ? আমি আমি খাঁটি সিলেটি ভাষায় বললাম কাউকে চাইনা। তিনি ভ্রু কুঁচকে বললেন তাহলে এখানে এসেছো কেন ? আমি জবাবে বললাম এমনি এসেছি, দেখার জন্য। তিনি কি মনে করে আমাকে বললেন আসো ভেতরে আসো। আমি অনুসরণ করে ভেতরে গেলাম। অফিস ঘরের মতো একটা ঘরে আমাকে নিয়ে বসালেন সেখানে দুজন মহিলা সহ জনাপাঁচেক লোকজন ছিলো। আমি সিলেট থেকে আজম খানের সাথে দেখা করতে এসেছি শুনে তিনি অনেক্ষণ হাসলেন। লোকটার হাসি দেখে আমি বিরক্তিতে ফেটে পড়ি। ভেবেছিলাম তিনি আমাকে আজম খানের ঠিকানা দিয়ে সাহায্য করবেন এখন দেখি তার উল্টো তিনি আমাকে নিয়ে বিদ্রুপ করছেন। পাশের লোকজনের করুনাময় চেহারা দেখে কিছুটা লজ্জাও পাচ্ছিলাম। লোকটাকে আমার খারাপ লাগতে শুরু করলো, আমি উঠে যেতে চাইলে তিনি আমাকে হাত ধরে আবার বসালেন। টি বয়কে দিয়ে চা বিস্কিট আনিয়ে আমাকে খাওয়ালেন। এখন লোকটাকে আর খারাপ লাগছে না। তাকে জিজ্ঞেস করলাম আপনি আমার কথা শুনে হাসলেন কেন ? তিনি আমাকে বললেন আমার বয়সে তিনিও এরকম পাগলামী করতেন। বাড়িতে কাউকে কিছু না বলে হুট হাট করে বেরিয়ে পড়তেন, বাড়িতে যখন ফিরে যেতেন তখন তার বাবার হাতে ছ্যাচা খেতে হতো। তার কিছু স্মৃতিও আমাদের কাছে শেয়ার করলেন। শেষে তিনি আমাকে আজম খানের ঠিকানা একটা কাগজে লিখে দিলেন। "আজম খান" ২, কবি জসিম উদ্দিন রোড, কমলাপুর, ঢাকা। আমি তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। আসার সময় বললেন কোন সমস্যা হলে যেন আমি তাকে জানাই তিনি আমাকে সাহায্য করবেন। তখনি লোকটার প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে যায়। যদিও আর কখনোই উনার সাথে আমার দেখা হয়নি তবুও উনাকে মনে রেখেছি শ্রদ্ধাভরে...
অনেক্ষণ থেকে কলিং বেলের সুইচে তর্জনীটা দাবিয়ে রেখেছি, তর্জনীটা গর্জন না করলেও বেলটা ঠিকই তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে কিন্তু কেউ সাড়া দিচ্ছেনা। সেলিব্রিটিদের বাড়ীর এই একটা সমস্যা অত সহজে সদর দরজা খুলতে কেউ চায়না। বেল বাজবে, কাজের লোক আসবে, পিপহোলের ভেতর দিয়ে আগন্তুককে এক নজর দেখে নেবে তারপর সাহেবকে জানাবে, সাহেব অনুমতি দিলে ফের এসে দরজা খুলে দিবে। কিন্তু আমি তাদেরকে সেই সুযোগ দিচ্ছিনা। বাঁ হাত দিয়ে পিপহোলের মুখটা চেপে ধরে আছি। একটু পরে ঠাশ করে দরজা খুলে গেলো। দরজার ওপাশে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তার দিকে তাকানো যায়না। আমি মধ্য আকাশের সূর্য্যের দিকে এক নাগাড়ে তাকিয়ে থাকতে পারি কিন্তু অত ফর্সা মেয়ের দিকে তাকাতে পারিনা। চোখে ফোস্কা পড়ে যায়। চোখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আজম খান ভাই কি বাসায় আছেন ? মেয়েটি না বলতে একটুও সময় নেয়নি, ভাবলাম মেয়েটা সুন্দর হলেও ওর মধ্যে দুই নম্বরী স্বভাব আছে। তা না হলে এতো কাঠ খোট্টা ভাবে কেউ না বলে না। আমি আবারো বললাম, আমি সিলেট থেকে এসেছি উনার সাথে দেখা করার জন্য। মেয়েটি ভাবলেশহীন ভাবে বললো আব্বু ত এখন বাসায় নেই পরে আইসেন। আমি ফিরে যেতে চাইলে কি মনে করে আমাকে ভেতরে আসার জন্য ডাকলো। আমার হাতে মিষ্টির দুটো প্যাকেট সহ চিপস আর কিছু চানাচুর ছিলো। হয়তো ওগুলো দেখে লোভ সামাল দিতে পারেনি... :P :P আমাকে ভেতরে নিয়ে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসিয়ে মেয়েটি ভেতরে চলে গেলো। আমার পাশে বসে ছোট্ট একটি মেয়ে টিভি দেখছিলো। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা ট্রেতে করে এক কাপ চা সহ কিছু নাশতা নিয়ে মেয়েটি আবার ফিরে এলো। আমি নাশতা খেতে খেতে জানলাম মেয়েটির নাম ইমা খান। আজম খানের বড় মেয়ে ক্লাস এইটে পড়ছে। কিছুক্ষণ কথা বলার পর আমি উঠে যেতে চাইলে যে জানিয়ে দিলো বিকেলে আবার আসার জন্য তখন নাকি আজম খান বাসায় থাকবেন। আমি হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়িয়ে বের হয়ে গেলাম।
আমি যার সামনে বসে আছি তিনি কোন সাধারণ মানুষ নন। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, তিনি একজন জনপ্রিয় গায়ক, তিনি একজন গুরু। যার হাত ধরে বাংলাদেশে ব্যান্ড বা পপ সঙ্গীতের সূচনা হয়েছিলো। আমি ভীষণ ভাবে পুলকিত। যার গান শুনে শুনে বড় হয়েছি। তিনি এখন আমার চোখের সামনে, বিশ্বাস হচ্ছেনা আমার। আমি কখনোই ভাবিনি তার সাথে আমার দেখা হবে। সীমাহীন স্নেহ দিয়ে আমার সাথে নানান রকমের কথা বললেন। আমার চোখ দিয়ে আনন্দাশ্রু বের হতে লাগলো। আমি দৌড় দিয়ে পাশের একটা দোকান থেকে একটা ডাইরী কিনে তার সামনে বাড়িয়ে দিলাম। তিনি বেশ কিছুক্ষণ ভেবে ডাইরীর পাতায় লিখলেন "সুমন এই পৃথিবী থাকবে যতদিন তোমাকে ভালোবেসে যাবো তত দিন" আরো বেশ কিছুক্ষণ আজম খানের সাথে সময় কাটিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। তিনি আমাকে তার বাসা থেকে এগিয়ে রিক্সায় তুলে দিলেন। বাসায় ও বাসার বাইরে তার সাথে বেশ কিছু ছবি তুল্লাম সাথে নিয়ে আসা ক্যামেরা দিয়ে। হোটেলে ফিরে এসে বার বার ডাইরীর পাতায় আজম খানের দেয়া অটোগ্রাফটা দেখতে লাগলাম। হঠাৎ করেই লক্ষ্য করলাম তিনি তত এর উপর কোন রেখা টানেননি বলে সেটা ৩৩ এর মতো হয়ে গেলো!! খুব হাসি পেলো আমার। পরদিন সকালে জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন নিয়ে বাড়িতে ফিরে এলাম। বাড়িতে ফিরে এসে কি কেয়ামত হয়েছিলো তা না হয় অন্য কোন একদিন বলার সুযোগ হলে জানিয়ে দেবো...
জবরুল আলম সুমন
সিলেট।
১৯শে ফেব্রুয়ারী, ২০১১ খৃষ্টাব্দ।
এখনকার মত তড়িৎ যোগাযোগের অত সুযোগ ছিলোনা বলে তাৎক্ষণিক ভাবে কারো সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হতো না। তখনো আমাদের বাসায় টেলিফোন লাইন আসেনি। আমাদের বেশীর ভাগ আত্মীয় স্বজন দেশের বাইরে থাকলেও তাদের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিলো চিঠি-পত্র ও আশপাশের লোকজন আসা যাওয়ার মাধ্যমে খবর আদান-প্রদান করা হতো। কাউকে কিছু না জানিয়ে আসায় আমি মোটেও চিন্তিত নই বরং আমি প্রচন্ড রকমের বিরক্ত ট্রেনের এক ঘেয়েমি টাইপের কুৎসিত শব্দ শুনতে শুনতে। আমার যেন সময় কাটছেনা। কখন ট্রেনটা ঢাকায় পৌছাবে, কখন আজম খানের সাথে দেখা হবে কিংবা আদৌ দেখা হবে কি না। সিলেট থেকে রাত ১০টায় ছেড়ে আসা উপবন ট্রেন সকাল ৭টায় ঢাকায় পৌছালো। আমি হাত ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে হাঁটা শুরু করে দিলাম আর মনে মনে গন্তব্য ঠিক করতে লাগলাম। কিন্তু কোথায় যাবো, কোথায় উঠবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কারণ আমি এর আগেও একাধিকবার ঢাকায় এলেও তা আব্বুর মধ্যমা আঙ্গুল আমাকে আমার গন্তব্যে পৌছে দিতো। আগে ঢাকার কাপ্তান বাজারে হোটেল বিলাস নামে আমাদের একটা আবাসিক হোটেল ছিলো। আব্বু আর বড় চাচা মিলে সেটা চালাত। তাই আমরা ঢাকায় বেড়াতে বা কাজে এলে আমাদের হোটেলে উঠতাম সেটাও প্রায় বছর পাঁচেক আগে বিক্রি করে দিয়ে বড় চাচা চলে গেলো আমেরিকায় আর আব্বু চলে গেলো লন্ডনে। তাহলে এখন আমি কোথায় উঠবো ? আমাদের নিকট আত্মীয়দের মধ্যে তেমন কেউ ঢাকায় থাকেনা, টুকটাক যারা আছেন তাদের কারো বাসার ঠিকানা আমি জানিনা।
কিছুটা ভয় ভয় লাগছে যদি অনাকাংখিত কোন ঘটনা ঘটে তাহলে কি করবো ? ঢাকার রাস্তা ঘাট কিছুই চিনিনা। একটা রিক্সায় চেপে বসলাম, রিক্সাওয়ালা জিজ্ঞেস করলো কোথায় যাবো আমি কোন কিছু না ভেবেই বলে দিলাম মগ বাজারে যাবো। তখন কোন বিশেষ একটা কারণে মগ বাজার নামটার সাথে খুব পরিচিত ছিলাম। (পত্রিকার পাতায় প্রায় পড়তাম মগবাজারের অমুক ষ্টুডিওতে তমুক শিল্পীর গান ধারণ করা হচ্ছে)। রিক্সার তিনটা চাকা সমানে চলছে সেই সাথে চলছে আমার ভয়ার্ত ভাবনারা। বিভিন্ন দোকানের সাইনবোর্ড দেখেই টের পেলাম মগবাজার চলে এসেছি। মগবাজারের চৌরাস্তার পাশে রিক্সাওয়ালা আমাকে নামিয়ে দিলো। পাশের একটা রেষ্টুরেন্টে নাস্তা সেরে থাকার জন্য হোটেল খুজতে লাগলাম অল্প সময়ের মধ্যেই পেয়ে গেলাম বেশ কিছু আবাসিক হোটেল। তার মধ্য একটাতে উঠে গেলাম। হোটেলে উঠে ফ্রেশ হয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম আজম খানের ঠিকানা যোগাড় করার জন্য। একটা দোকানে ঢুকলাম জুস কিনতে আমার ভাষার মধ্যে সিলেটি ভাষা মিশ্রণ দেখেই সে বুঝে নিলো আমি সিলেট থেকে এসেছি। দোকানী ছেলেটা আমার সাথে খাতির জমানোর চেষ্টা করলে নিজেই আরো এক ধাপ বাড়িয়ে তার সাথে কথা বলা শুরু করি। আমার উদ্দেশ্য ছিলো তার মাধ্যমে কোন একটা রেকর্ডিং ষ্টুডিওর ঠিকানা বের করা। আমি উদ্দেশ্যে সফল হলাম। তার মাধ্যমেই পেয়ে গেলাম শ্রুতি অডিও রেকর্ডিং ষ্টুডিওর ঠিকানা। আমি তখন কাল ক্ষেপন না করে পা বাড়ালাম শ্রুতি রেকর্ডিং ষ্টুডিওর উদ্দেশ্যে।
শ্রুতির দরজায় নক করতেই একজন ভূড়িওয়ালা লোক দরজা খুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো কাকে চাই ? আমি আমি খাঁটি সিলেটি ভাষায় বললাম কাউকে চাইনা। তিনি ভ্রু কুঁচকে বললেন তাহলে এখানে এসেছো কেন ? আমি জবাবে বললাম এমনি এসেছি, দেখার জন্য। তিনি কি মনে করে আমাকে বললেন আসো ভেতরে আসো। আমি অনুসরণ করে ভেতরে গেলাম। অফিস ঘরের মতো একটা ঘরে আমাকে নিয়ে বসালেন সেখানে দুজন মহিলা সহ জনাপাঁচেক লোকজন ছিলো। আমি সিলেট থেকে আজম খানের সাথে দেখা করতে এসেছি শুনে তিনি অনেক্ষণ হাসলেন। লোকটার হাসি দেখে আমি বিরক্তিতে ফেটে পড়ি। ভেবেছিলাম তিনি আমাকে আজম খানের ঠিকানা দিয়ে সাহায্য করবেন এখন দেখি তার উল্টো তিনি আমাকে নিয়ে বিদ্রুপ করছেন। পাশের লোকজনের করুনাময় চেহারা দেখে কিছুটা লজ্জাও পাচ্ছিলাম। লোকটাকে আমার খারাপ লাগতে শুরু করলো, আমি উঠে যেতে চাইলে তিনি আমাকে হাত ধরে আবার বসালেন। টি বয়কে দিয়ে চা বিস্কিট আনিয়ে আমাকে খাওয়ালেন। এখন লোকটাকে আর খারাপ লাগছে না। তাকে জিজ্ঞেস করলাম আপনি আমার কথা শুনে হাসলেন কেন ? তিনি আমাকে বললেন আমার বয়সে তিনিও এরকম পাগলামী করতেন। বাড়িতে কাউকে কিছু না বলে হুট হাট করে বেরিয়ে পড়তেন, বাড়িতে যখন ফিরে যেতেন তখন তার বাবার হাতে ছ্যাচা খেতে হতো। তার কিছু স্মৃতিও আমাদের কাছে শেয়ার করলেন। শেষে তিনি আমাকে আজম খানের ঠিকানা একটা কাগজে লিখে দিলেন। "আজম খান" ২, কবি জসিম উদ্দিন রোড, কমলাপুর, ঢাকা। আমি তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। আসার সময় বললেন কোন সমস্যা হলে যেন আমি তাকে জানাই তিনি আমাকে সাহায্য করবেন। তখনি লোকটার প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে যায়। যদিও আর কখনোই উনার সাথে আমার দেখা হয়নি তবুও উনাকে মনে রেখেছি শ্রদ্ধাভরে...
অনেক্ষণ থেকে কলিং বেলের সুইচে তর্জনীটা দাবিয়ে রেখেছি, তর্জনীটা গর্জন না করলেও বেলটা ঠিকই তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে কিন্তু কেউ সাড়া দিচ্ছেনা। সেলিব্রিটিদের বাড়ীর এই একটা সমস্যা অত সহজে সদর দরজা খুলতে কেউ চায়না। বেল বাজবে, কাজের লোক আসবে, পিপহোলের ভেতর দিয়ে আগন্তুককে এক নজর দেখে নেবে তারপর সাহেবকে জানাবে, সাহেব অনুমতি দিলে ফের এসে দরজা খুলে দিবে। কিন্তু আমি তাদেরকে সেই সুযোগ দিচ্ছিনা। বাঁ হাত দিয়ে পিপহোলের মুখটা চেপে ধরে আছি। একটু পরে ঠাশ করে দরজা খুলে গেলো। দরজার ওপাশে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তার দিকে তাকানো যায়না। আমি মধ্য আকাশের সূর্য্যের দিকে এক নাগাড়ে তাকিয়ে থাকতে পারি কিন্তু অত ফর্সা মেয়ের দিকে তাকাতে পারিনা। চোখে ফোস্কা পড়ে যায়। চোখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আজম খান ভাই কি বাসায় আছেন ? মেয়েটি না বলতে একটুও সময় নেয়নি, ভাবলাম মেয়েটা সুন্দর হলেও ওর মধ্যে দুই নম্বরী স্বভাব আছে। তা না হলে এতো কাঠ খোট্টা ভাবে কেউ না বলে না। আমি আবারো বললাম, আমি সিলেট থেকে এসেছি উনার সাথে দেখা করার জন্য। মেয়েটি ভাবলেশহীন ভাবে বললো আব্বু ত এখন বাসায় নেই পরে আইসেন। আমি ফিরে যেতে চাইলে কি মনে করে আমাকে ভেতরে আসার জন্য ডাকলো। আমার হাতে মিষ্টির দুটো প্যাকেট সহ চিপস আর কিছু চানাচুর ছিলো। হয়তো ওগুলো দেখে লোভ সামাল দিতে পারেনি... :P :P আমাকে ভেতরে নিয়ে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসিয়ে মেয়েটি ভেতরে চলে গেলো। আমার পাশে বসে ছোট্ট একটি মেয়ে টিভি দেখছিলো। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা ট্রেতে করে এক কাপ চা সহ কিছু নাশতা নিয়ে মেয়েটি আবার ফিরে এলো। আমি নাশতা খেতে খেতে জানলাম মেয়েটির নাম ইমা খান। আজম খানের বড় মেয়ে ক্লাস এইটে পড়ছে। কিছুক্ষণ কথা বলার পর আমি উঠে যেতে চাইলে যে জানিয়ে দিলো বিকেলে আবার আসার জন্য তখন নাকি আজম খান বাসায় থাকবেন। আমি হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়িয়ে বের হয়ে গেলাম।
আমি যার সামনে বসে আছি তিনি কোন সাধারণ মানুষ নন। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, তিনি একজন জনপ্রিয় গায়ক, তিনি একজন গুরু। যার হাত ধরে বাংলাদেশে ব্যান্ড বা পপ সঙ্গীতের সূচনা হয়েছিলো। আমি ভীষণ ভাবে পুলকিত। যার গান শুনে শুনে বড় হয়েছি। তিনি এখন আমার চোখের সামনে, বিশ্বাস হচ্ছেনা আমার। আমি কখনোই ভাবিনি তার সাথে আমার দেখা হবে। সীমাহীন স্নেহ দিয়ে আমার সাথে নানান রকমের কথা বললেন। আমার চোখ দিয়ে আনন্দাশ্রু বের হতে লাগলো। আমি দৌড় দিয়ে পাশের একটা দোকান থেকে একটা ডাইরী কিনে তার সামনে বাড়িয়ে দিলাম। তিনি বেশ কিছুক্ষণ ভেবে ডাইরীর পাতায় লিখলেন "সুমন এই পৃথিবী থাকবে যতদিন তোমাকে ভালোবেসে যাবো তত দিন" আরো বেশ কিছুক্ষণ আজম খানের সাথে সময় কাটিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। তিনি আমাকে তার বাসা থেকে এগিয়ে রিক্সায় তুলে দিলেন। বাসায় ও বাসার বাইরে তার সাথে বেশ কিছু ছবি তুল্লাম সাথে নিয়ে আসা ক্যামেরা দিয়ে। হোটেলে ফিরে এসে বার বার ডাইরীর পাতায় আজম খানের দেয়া অটোগ্রাফটা দেখতে লাগলাম। হঠাৎ করেই লক্ষ্য করলাম তিনি তত এর উপর কোন রেখা টানেননি বলে সেটা ৩৩ এর মতো হয়ে গেলো!! খুব হাসি পেলো আমার। পরদিন সকালে জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন নিয়ে বাড়িতে ফিরে এলাম। বাড়িতে ফিরে এসে কি কেয়ামত হয়েছিলো তা না হয় অন্য কোন একদিন বলার সুযোগ হলে জানিয়ে দেবো...
জবরুল আলম সুমন
সিলেট।
১৯শে ফেব্রুয়ারী, ২০১১ খৃষ্টাব্দ।
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন