রং নাম্বার... (দুই পর্ব একত্রে)
১৯৯৯ সালের মাঝা-মাঝি সময় থেকে আমি নিয়মিত মোবাইল ফোন ব্যবহার করে আসছি। আঙ্গুলের ট্যাবে হিসেব কষে সময়টা বের করতেই আঁৎকে উঠি ১৩ বছর, এক যুগেরও বেশী !! এই ১৩ বছরে মোবাইল ফোন নিয়ে কম অভিজ্ঞতা হয়নি। পোষ্ট পেইড বা রেন্টাল কানেকশান সহ (তখন প্রিপেইড বা পে এ্যাজ ইউ গো ছিলোনা) শুরুতেই এরিকসন (সনি এরিকসন নয়, তখন সনি এরিকসনের জন্মই হয়নি) ব্র্যান্ডের যে হ্যান্ডসেটটা ছিলো তা দিয়ে কল দেয়া নেয়া ছাড়াও যে কারো মাথা অনায়াসে ফাটিয়ে দেয়া যায় কারণ আকার আয়তন ও ওজনে সেটা ছোট খাটো একটা মুগুরের সমান ছিলো, প্যান্টের পকেটে আঁটতো'না আর কোনটাতে আঁটলেও হাঁটতে গেলে দৃষ্টি কটু ভাবে প্যান্টের পকেটটা ফুলে উঠতো কি এক বিশ্রী ব্যাপার। অবশ্য তখন অনেকেই মোবাইল হাতে নিয়ে হাঁটতো, এটা তখন বিশেষ গৌরবের ব্যাপার ছিলোও বটে!।
রাস্তায় বেরুলে দেখা যেত অনেকেই কায়দা করে মোবাইল সেটটা হাতে নিয়ে হাঁটতেন যাতে আশ পাশের লোকজন দেখতে পারে যে অতি গুরুত্বপূর্ণ কেউ একজন একখান মোবাইল হাতে নিয়ে হাঁটছেন অনেকেই তখন ব্যক্তির দিকে না তাকিয়ে তার হাতে থাকা মোবাইল ফোনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো আর মনে মনে হয়তো নিজেকে ভর্ৎসনা করতো কেন সে এখনো একটা মোবাইলের গর্বিত মালিক হতে পারেনি বা কবে সে ঠিক এরকম একটা মোবাইল ফোনের মালিক হবে। সেসময় অবশ্য মোবাইল ফোন মালিকদের বিড়ম্বনা নেহায়েত কমও ছিলো না, তখনকার সময়ে সবচে সস্তা দামের হ্যান্ডসেটসহ এক একটা সংযোগ কিনতে কম করে হলেও পঁচিশ হাজার টাকা গুণতে হতো তাও একদিনে হতো না, ডাউন পেমেন্টে অর্ডার দিতে হতো আর ক'দিন পর পর খোঁজ নিতে হতো সংযোগ এলো কিনা। অবশেষে কাঙ্ক্ষিত সংযোগ নেয়ার পর মাস শেষে ৫/৬ হাজার টাকার বিল দেখে অনেকেই জ্ঞান হুশ হারিয়ে ওজু করে তওবা করেছেন বাকি জীবনে আর মোবাইল নামক যন্ত্রটা ছুঁয়েও দেখবেন না।
কেনা কাটার সাথে কোথায় যেন দেউলিয়া হওয়ার একটা বিশেষ যোগসূত্র আছে। অনেকেই হয়তো কেনা কাটা করে দেউলিয়া হয়েছেন বলে সৈয়দ মুজতবা আলী বাধ্য হয়ে বা কিছুটা আক্ষেপ করে লিখেছিলেন "বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয়না"। বই কিনে যেমন কেউ দেউলিয়া হয়না তেমনি একটা মোবাইল কিনেও কেউ দেউলিয়া হয়না তবে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে করে অনেকেই দেউলিয়া হয়ে গেছে। এ ব্যপারে এই মুহুর্তে আমার একটা ঘটনা মনে পড়ছে। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু সঙ্গত কারণে নাম প্রকাশ করছিনা। তার বাবা বিরাট বড় লোক। কিন্তু সে তার বাবার কাছ থেকে খুব বেশি টাকা পয়সা আদায় করতে পারতোনা। তাই আমরা প্রায়ই তাকে বড় লোক বাপের গরিব সন্তান বলে ক্ষেপাতাম। সেই সাথে তাকে আমরা বগুড়া (বক পাখির সিলেটী ভার্সন) বলে ডাকতাম উচ্চতায় সে আমাদের বন্ধু মহলের সবাইকে টপকে গিয়েছিলো বলে, ছ'ফুটের উপরে তার মাথার অবস্থান। দীঘে সবাইকে ছাড়িয়ে গেলেও প্রস্থে সুবিধা করতে পারেনি বেচারা। বাঁশের সাথে তার দারুণ মিল রয়েছে, দীঘে বাঁশের কাছা কাছি হলেও শরীরটাও ঠিক বাঁশের পাতার মতোই চিকন চাকন। গার্ল ফ্রেন্ড জুটিয়েছিলো দুই তিনটা কিন্তু কাউকে নিয়েই রিক্সায় চড়তে পারেনি ভালো মতো। রক্ষণশীল সমাজ বলেই সিলেটে সাধারণত কোন মেয়ে রিক্সায় থাকলে হুড তুলতে হয় কিন্তু সে যখন তার গার্ল ফ্রেন্ড নিয়ে রিক্সায় চড়ে তখন রিক্সায় হুড তোলা হলে তার গলাটা বকের মতোই বেরিয়ে আসতো, যেকারো নজরে পড়ার মতো ঘটনা বটে। পথচারীদের অনেকেই হা করে তাকিয়ে থাকতো পরিচিতদের মধ্যে কেউ কেউ টিপ্পনি কাটতো গলার উপরের বাড়তি অংশটা করাত কলে গিয়ে কেটে ফেললেই ত ঝামেলা চুকে যায় তাহলে আর এতো কষ্ট করতে হতো না।
এসব অশ্রাব্য মন্তব্যে অবশ্য তার কিছু যায় আসেনা, বন্ধু মহলে এধরনের কথা শুনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। যাহোক, বেশ কিছু দিন থেকে সে তার বাবার কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করতো একটা মোবাইল ফোন কিনে দেবার জন্য, কিন্তু তার বাবা কোন ভাবেই রাজি হচ্ছিলেন না। এদিকে আমাদের বন্ধুদের প্রায় সবাই মোবাইলের মালিক বনে গেছে। আমি অবশ্য এই ক্ষেত্রে সবার থেকে অগ্রজ কারণ আমি ঢাকায় থাকতাম বলেই মোবাইল আগেই কিনে নিয়েছি, সিলেটে সম্ভবত মোবাইলের নেটওয়ার্কের অন্তর্ভূক্ত হয়েছে ২০০০ সালের মাঝা-মাঝি বা শেষের দিকে। যাহোক, অবশেষে সে তার বাবাকে ফুসলিয়ে একটা মোবাইল ফোন আদায় করে নেয়। কিন্তু সে কাউকেই ফোন করতো না, মিসড কলের মধ্যেই তার ফোন সীমাবদ্ধ ছিলো তখন অবশ্য প্রতিমিনিট কল চার্জ ছিলো ৭টাকা কল না করে মিসড কল দেয়ার এটাও একটা কারণ ছিলো। একটু পর পর আমাকে মিসড কল দিয়ে জ্বালিয়ে মারতো, কাউকেই সে রেহাই দিত না।
একটা সময় তার মিসড কলে আমরা বিরক্ত হয়ে তার নাম 'মিসকল' রাখি! আমাদের বন্ধু মহলে সে তখন মিসকল নামেই সমধিক পরিচিত। একদিন তার মোবাইলে এক অপরিচিত নাম্বার থেকে মিসড কল আসে। কিন্তু সে কল ব্যাক না করে তাকেও মিসড কল দেয় বিপরীত ফোন থেকে আবারো মিসড কল আসে সেও যথারীতি কল না দিয়ে মিসড কল দিয়ে যাচ্ছে। তাদের মিসড কল মিসড কল খেলা বেশ ক'দিন চলো। তারপর একদিন আমরা সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছি ঠিক তখনী বিপরীত ফোন থেকে মিসকলের মোবাইলে একটা এস.এম.এস এলো "Apni eto kipta keno? Ekta call dite paren na?" হয়তো আমরা তখন সামনে ছিলাম বলেই মিসকলের গায়ে লাগলো এস.এম.এস-এর কথাটা। কিছুটা চেঁচিয়ে উঠে কল ব্যাক করে কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে কল রিসিভ করা হচ্ছেনা, কিন্তু সমান তালে মিসড কল দিয়ে যাচ্ছে। মিসকলও থেমে নেই সেও কল করে যাচ্ছে অনবরত, একটা সময় কলটি রিসিভ হয়। কিন্তু এ্যাঁ কি মিসকল এভাবে মোমের মতো গলে গলে পড়ছে কেন ? রহস্যটা উদ্ঘাটন করতেই আমরা সবাই মিসকলের মোবাইলে কান লাগাই, মিসকল তখনো কথা বলে যাচ্ছিলো। অপর প্রান্তে সুকন্ঠী কোন এক মেয়ের কন্ঠ আমরা শুনতে পেলাম, মিসকল তখন তার মোবাইল নিয়ে কথা বলতে বলতে আমাদের আড়ালে চলে গেলো।
মিসকলের সাথে এখন ওই সুকন্ঠী মেয়েটার দারুণ ভাব! ভাব বললে ভুল হবে, যা হবার হয়ে গেছে... হুম প্রেম! মাত্র দু'দিনের মধ্যেই মনের লেন-দেন হয়েই গেলো। মিসকল প্রেমে পড়ায় আমাদের একটা লাভ হলো কারণ সে এখন আর আমাদের জ্বালাতন করেনা আগের মতো। সন্ধ্যে বেলা নিয়মিত আমাদের আড্ডায় এলেও সে তার মোবাইল টিপাটিপিতেই ব্যস্ত থাকে, মানে এস.এম.এস-এর আদান প্রদান হচ্ছে। আমরাও তাকে খুব বেশি ঘাঁটাইনা, প্রেম করছে করুক। প্রেম মানুষের মৌলিক অধিকার না হলেও ব্যক্তিগত অধিকার বলে আমি মনে করি আর প্রতিটা মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত একটা জীবন আছে কারো ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করা উচিত না। এদিকেও আমিও ঢাকায় ফিরে গেছি আমার কর্মস্থলে। কিন্তু আমি প্রতি মাসের ২৫ তারিখে সিলেটে যেতাম আর ১ তারিখে ঢাকায় ফিরতাম। তাদের প্রেম তখন তুঙ্গে, তখন মোবাইলে এফ.এন.এফ এর কোন ব্যবস্থা ছিলোনা, প্রতিটা নাম্বারেই একই কল রেট প্রযোজ্য। ফলে প্রতি মিনিট ৭টাকা করে কথা বলা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়তো বিশেষ করে প্রেমের ক্ষেত্রে। কিন্তু প্রেমের কথা বার্তা অল্পতে কিছু হয়না, প্রেমে অল্প বলে কোন শব্দ নেই যা আছে তার সব বেশি বেশি। তিন'শ টাকার কার্ড রিচার্জ করে মাত্র ৪৩মিনিটের কথায় ব্যালেন্স ফুরিয়ে যেত!
তার জমানো হাজার দশেক টাকা ছিলো সবটাই মাত্র অল্প ক'দিনের মধ্যেই চেটেপুটে গ্রামীণ ফোনকে খয়রাত করে দিয়েছে প্রেম টিকিয়ে রাখতে। কিন্তু এখন কি করবে বেচারা, তিন'শ টাকার নীচে রিচার্জ করারও কোন সুযোগ ছিলো না তখন। বন্ধুদের কাছে হাত পাতা শুরু হয়ে গেলো, বন্ধুরাও নিরাশ করেনি তাকে। অনেকটা চাঁদা তুলে তুলে তার প্রেম টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। প্রতিদিন তিন'শ টাকা ! এর মধ্যে বাবা মায়ের কাছ থেকে কসরত করে যা খসাতে পারতো তা বাড়তি কথা বলার জন্য। বন্ধুরা মিলে আরোও এক মাসে মতো চালালাম। কিন্তু আর কত ? আমাকে তখন প্রায়ই ফোন করতো আমি সময় সুযোগে তাকে কার্ডের নাম্বার পাঠিয়ে দিতাম। আরোও কিছুদিন পর বন্ধুরা সাহায্যের হাত প্রায় গুটিয়ে নিলো। আমিও তখন বিশেষ কাজে মাস দেড়েকের জন্য কলকাতায় চলে গেলাম। কলকাতা থেকে ফিরে এসে শুনলাম, অন্যান্য বন্ধুরা সাহায্যের হাত পুরোপুরি বন্ধ করে দিলে সে খুব বিমর্ষ হয়ে পড়ে। বাবা মায়ের কাছে চেয়েও পর্যাপ্ত টাকা না পেয়ে শেষে একে একে তার শখের ক্যামেরা, পোর্টেবল ডিভিডি প্লেয়ার, প্লে ষ্টেশন, গলার স্বর্ণের চেইন বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয় এরই মধ্যে দুই একটা বিক্রিও করে দিয়েছে। আমি তাকে অনেক বারণ করেছি সাধ্যমত সাহায্য করে। কিন্তু সে আমার কথা শোনেনি। একে একে তার সব কিছুই বিক্রি করতে থাকে। একটা সময় তার প্রেমিকা তাকে চাপ দেয় দেখা করার জন্য, কিন্তু কিভাবে দেখা করবে তার হাতে তেমন টাকা পয়সা নেই। কিন্তু তাতে তার খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা নয়, কারণ তার প্রেমিকার অবস্থান ঢাকায়। আমিও ঢাকায় থাকি, সুতরাং তার তেমন খরচা নেই যেহেতু আমি ঢাকায় আছি। তাকে বললাম তুই কোন রকমে চলে আয় বাকিটা আমি দেখবো।
সে পাঁচ সাত দিনের মধ্যেই ঢাকায় চলে এলো, আমি তখন ভীষণ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছি আমার পেশাগত কারণেই। গুলশানের একটা রেষ্টুরেন্টে তারা দেখা করবে বলে ঠিক করেছে, আমাকে অনেক অনুরোধ করলো তার সাথে থাকার জন্য কিন্তু আমি ষ্টুডিও নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তার সঙ্গে যেতে পারিনি। তাকে আমি কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিউ ইস্কাটন থেকে ট্যাক্সিতে তুলে দিয়ে আমি ষ্টুডিওতে চলে যাই, পথি মধ্যে সে আমাকে বার দুয়েক ফোনও করে। কথা ছিলো সে গুলশানের ওই রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ সেরে মগবাজারে চলে আসবে, তার আসতে আসতে তিন চারটা বাজবে। সেই সাথে তাকে আমি আমার রুমের চাবিটা দিয়ে দিই যদি সে সময়ের আগে চলে আসে তবে যেন রুমে বসে বিশ্রাম নেয়। তিনটা বাজে, চারটা বাজে তার আসার নাম নেই। পাঁচটার দিকে আমি তার মোবাইলে ফোন দিই, কিন্তু এ্যাঁ কি! তার ফোন অফ!! আমি বার বার তার মোবাইলে ফোন করতে থাকি কিন্তু ফোন আর ওপেন করছেই না। আমি কিছুটা রেগে যাই, শালা প্রেমিকা পেয়ে আমাকে ভুলে গেছে। ছ'টা পর্যন্ত তাকে আমি ফোন দিই কিন্তু নাহ ফোন এখনো অফ করেই আছে। আমি ষ্টুডিও থেকে বাসায় ফিরে আসার জন্য তৈরী হচ্ছি, রাতে আবারো ষ্টুডিওতে আসতে হবে কারণ রাত দশটার দিকে প্রথম সারির নামকরা একজন আর্টিস্টের রেকর্ডিং আছে তিনি আমাকেই চাইছেন তার শিফটে। আমি বাসায় ফিরে প্রায় আঁৎকে উঠি, রুমের দরজার ভেতর থেকে বন্ধ! আমি দরজায় বার কয়েক নক করার পর মিসকল দরজা খোলে। তার মলিন মুখ দেখেই বুঝে নিলাম কোন গন্ডগোল হয়েছে। আমি তখন তাকে বললাম, কিরে ফোন অফ করে রেখেছিস কেন ? তুই আমাকে একটা কল করে বলতে পারতি যে তুই চলে এসেছিস, আমাকে আর এতো টেনশান করতে হতো না। কিন্তু সে কোন কথা-ই বলছেনা। অনেক সাধা সাধির পর যা বললো তা শুনে আমার মাথা ঘুরে এলো। এমনও হয় !!!
গুলশানের নির্ধারিত ওই রেষ্টুরেন্টে তাদের দেখা হয়। মেয়েটা মোটামোটি সুন্দরী (তার ভাষায়)। প্রথমে হাল্কা কিছু খাবারের অর্ডার দেয়া হয়। খেতে খেতে মিনিট দশেক কথার পর হঠাৎ মেয়েটার মোবাইলে একটা কল আসে। মেয়েটি তখন মিসকলকে বলে তোমার মোবাইলে কি টাকা আছে, আমার একটা জরুরী ফোন আছে দুই চার মিনিট কথা বলতে হবে। মিসকল তখন হাসিমুখে তার মোবাইল মেয়েটার হাতে ধরিয়ে দেয়, মেয়েটি তখন ৩০ সেকেন্ডের মতো কথা বলে লাইনটা কেটে দেয় তারপর মিসকলকে বলে ফোনের রিসিপশানে সমস্যা করছে তুমি একটু বসো আমি জরুরী কথাটা সেরে নিই, তখন মেয়েটি আবারো মিসকলের মোবাইল থেকে কল দিয়ে হ্যালো হ্যালো বলে রেষ্টুরেন্টের বাইরে চলে যায়। মেয়েটি সেই যে বাইরে গেলো আর ফিরে এলো না। মিসকলের মোবাইল নিয়ে উধাও হয়ে গেলো। প্রেমিকা, মোবাইল, জমানো টাকা শখের জিনিষপত্র হারিয়ে মিসকল পাথর হয়ে গেছে, তার চোখের কোণা দিয়ে অশ্রু ঝরতে দেখে আমার চোখেও অশ্রু আসার যোগাড়, নিজেকে সামলে নিলাম কোন ভাবে। সময় বসে থাকেনা চলতেই থাকে, সময়ের ঘূর্ণিপাকে আজ এই ঘটনা কেবলি স্মৃতি। মিসকল এখন আর আমাকে মিসড কল দেয় না, কলই দেয়। প্রত্যেক মাসে দুই একবার করে কল দেয়, বর্তমানে সে দুই বাচ্চা আর বউ নিয়ে লন্ডনের এসেক্সে বিশাল একটা বাড়িতে থাকে। সম্প্রতি তার সাথে আমার কথা হয়েছে এই ঘটনাটি তখন মনে পড়েগিয়েছিলো খুব হেসেছিলাম ঘটনাটি বলতে বলতে।
ফোন ব্যবহার করছেন অথচ রং নাম্বার থেকে কল আসেনি এমন কোন ব্যবহারকারী হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবেনা। রং নাম্বার থেকে পরিচয় অতঃপর প্রেম পর্ব সেরে ঘর সংসার করা জুটির অভাব নেই আমাদের দেশে। ২০০৫ থেকে নিয়মিত কিছু মানুষ আমাকে ফোন করে রঙ মিস্ত্রী বেলালের খোঁজ করতো। কারণ বেলাল নামের কোন এক রঙ মিস্ত্রী তার ভিজিটিং কার্ডে ভুলক্রমে আমার নাম্বারটা ছাপিয়ে দেয়। কিন্তু সে আর নাম্বারটা সংশোধন না করেই মানুষজনকে কার্ড বিতরণ করতে থাকে, ফলে প্রায়শই তার ঝামেলা আমাকে সামাল দিতে দিতো। রং নাম্বার থেকে ফোন এসে সবচে মজার কান্ডটি ঘটেছে বছর তিন আগে, মধ্য বয়স্ক একজন মহিলা আমাকে ফোন করেছেন কিন্তু আমাকে হ্যালো বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি এক নাগাড়ে বলেই চলেছেন... "বাবাজি, মেয়েটা আমার খুবই অবুঝ কতই বা আর বয়স এখনো ভালো মন্দ বুঝতে শেখেনি। আমি জানি তার এভাবে রাগ করে চলে আসাটা ঠিক হয়নি কিন্তু আগেই ত বললাম ও একটা অবুঝ, ওর যদি কান্ড জ্ঞান থাকতো তাহলে কি এভাবে একটা দুধের বাচ্চা রেখে ফেলে আসতো ? বাবাজি আপনি কিছু মনে করবেন না। শাকিল বাড়িতে নেই ও ঢাকায় গেছে এ্যাম্বেসিতে কাগজ পত্র জমা দিতে ও যদি বাড়িতে থাকতো তাহলে ওকে দিয়েই আমি নাসিমা-কে পাঠিয়ে দিতাম। তোমার শ্বশুড়ও খুব অসুস্থ্য নইলে তিনিই নাসিমা'কে পৌছে দিয়ে আসতেন। তাই রাগ গোস্যা না করে কাল আপনিই চলে এস নাসিমা'কে নিয়ে যাবেন"
এই পর্যায়ে আমি ওই ভদ্র মহিলাকে থামালাম বললাম আপনি ভুল নাম্বারে ফোন করেছেন আমি আপনার মেয়ের জামাই নই, কিন্তু তিনি আমার কথা শুনতে নারাজ, একা একা বলেই চলেছেন। এক পর্যায়ে আমি লাইনটা কেটে দিই, একটু পর আবারো কল আসে ওই নাম্বার থেকে। আমি ধরলাম, যথারীতি হ্যালো বলার আগেই মহিলার কন্ঠ "বাবা দয়া করে আর রাগ করবেন না, মানুষ ভুল করে আবার মানুষই তার সংশোধন করে ও একটা ভুল করে ফেললো তাই বলে আপনি কি তাকে সংশোধন করে দিতে পারেন না ? ঝগড়া ঝাটি আপনারা করেছেন কিন্তু মাঝ পথে বাচ্চাটা কষ্ট পাচ্ছে, অন্তত বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে ওকে ক্ষমা করে দিন" আমি আবারো মহিলাটিকে থামালাম বললাম আন্টি আপনি আসলে ভুল নাম্বারে ফোন করেছেন আপনি যাকে ভেবে ফোন করেছেন আমি সেই জন না, তিনি আবারো আমাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে নানান কথা বলতে শুরু করেছেন। আমি বাধ্য হয়ে আবারো লাইনটি কেটে দিই, কিন্তু মহিলাটি নাছোড় বান্দা আবারো কল করেন আমি আর রিসিভ করিনি, এরপর তিনি আরোও কয়েক বার কল দিয়েছিলেন কিন্তু আমি কল রিসিভ না করে কয়েক ঘন্টার জন্য ফোনটাই অফ করে দিই।
আরো একবার অন্য একটা রং নাম্বার থেকে ফোন এসে আমার পারিবারিক মান-সম্মানের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিলো। আমি তখন আমার ফোনটা আমার বেড রুমে রেখে কোন একটা জিনিষ কিনতে পাশের দোকানে গেছি ততক্ষণে আমার মোবাইলে একের পর কল আসতে শুরু করে, আমার ফোন সাধারণত অন্য কেউ রিসিভ করেনা। কিন্তু এক নাগাড়ে ফোন বাজতে দেখে আমার ছোট ভাই কলটি রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে অভিমান ভরা কন্ঠে বলতে লাগলো "তুমি এখনো আসছো না কেন ? সেই কখন থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি, বাংলালিংকটা অফ করে রাখছো কেন ? ভেবেছিলাম আজ সারাদিন তোমাকে নিয়ে রিক্সায় ঘুরবো কিন্তু সারাটা দিন ত তোমার অপেক্ষাতেই চলে যাচ্ছে আর কত অপেক্ষা করাবে ?" শেষ লাইনটিই আমার ছোট ভাইয়ের জন্য যথেষ্ট ছিলো ওই অভিমানী মেয়েটার সাথে আমার কি সম্পর্ক তার নির্ণয় করতে। "ভাইয়া বাইরে গেছে আপনি পাঁচ মিনিট পরে তাকে ফোন দিন" আমার ছোট ভাইয়ের কথা শেষ করতে না করতেই অপর প্রান্ত থেকে কলটি কেটে দেয়। আমি ঘরে ফিরে এসেছি, কিন্তু কোথাও বের হচ্ছিনা দেখে একটু পর পর আমার ছোট ভাইটা আমার ঘরের আশ পাশে সন্দেহ জনক ভাবে ঘুর ঘুর করতে লাগলো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম কিরে কি হয়েছে ? সে আমাকে কিছু না বলেই চলে গেলো। আমি সারাদিন বাসাতেই ছিলাম কোত্থাও আর বের হইনি।
সন্ধার দিকে সাধারণত আমি আড্ডা দিতে বের হই বন্ধুদের সাথে, তেমনি সেদিন আড্ডা শেষ করে ঘরে ফিরেই দেখি আমার জন্য পারিবারিক পার্লামেন্ট বসেছে, সবাই গোল হয়ে ড্রয়িং রুমে ফ্লোরে বসে আছে। স্পিকারের দায়িত্বে আছেন আমার মা, বাকিরা সবাই আমার বিরোধী দল। অবশ্য এই সংসদে আমার বাবা আর বড় ভাই অনুপস্থিত। আমি বাসায় ফিরতেই মা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন কিরে মেয়েটা কে, বাড়ি কোথায় ? আমি তাৎক্ষনিক ভাবে কিছু বুঝতে না পেরে পাল্টা প্রশ্ন করলাম কোন মেয়েটা ? অন্য সবাই তখন চোখ ট্যারা করে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে মা তখন গলার স্বর কিছুটা বিকৃত করে বললেন আর ভান করতে হবেনা আমরা যা জানার জেনে গেছি, এবার চট করে বল কে ঐ মেয়ে ? আমি অনেকটা অসহায়ের মতো বললাম মা তোমরা কি জানতে চাচ্ছো আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। আমার ছোট ভাইটা তখন বলে উঠলো দুপুরে তুমি যখন বাইরে ছিলে তখন তোমার লাভার ফোন করেছিলো আমি ফোনটা রিসিভ করি। এবং মেয়েটি কি বলেছিলো তাও ভেংচি কেটে বললো। আমি আঁৎকে উঠি, আমার লাভার !! বলে কি ওরা... আমি সাথে সাথে আমার ফোনের কল লিষ্ট বের করে দেখলাম অপরিত একটা নাম্বার থেকে তখন আমার মোবাইলে ফোন এসেছিলো। কিন্তু ওই মেয়েটি আমাকে পরে আর ফোন করেনি তাই বিষয়টা আমার জানা ছিলো না।
আমি বললাম এটা একটা রং নাম্বার ছিলো কিন্তু কেউ বিশ্বাস করতে চাচ্ছেনা দেখে আমি লাউড স্পিকার অন করে ওই নাম্বারে কল ব্যাক করলাম। ফোনটা রিসিভ করতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম এই নাম্বার থেকে দুপুরে আমার মোবাইলে একটা কল এসেছিলো সেটা কি আপনি করেছিলেন ? তখনি ওই মেয়েটা বললো সরি ভাইয়া আসলে একটা ডিজিট ভুল করে ফেলায় আপনার নাম্বারে চলে গিয়েছিলো আই এ্যাম এক্সট্রিমলি সরি ফর দ্যাট। আমি তখনি আচ্ছা ঠিক আছে বলে ফোনটা কেটে দিলাম। কিন্তু তারপরও কাউকে বিশ্বাস করানো যাচ্ছে না, সবাই ভাবছে এটা আমাদের পরিকল্পিত। বেশ কিছু দিন সবার সন্দেহের তীর আমার দিকে ছিলো, আমার কোন ফোন আসলেই দরজার ওপাশে গোয়েন্দাদের আনা গোনা টের পেতাম আমি ফোনটা ছেড়ে দিলে তারা পরাজিত সৈনিকের বেশে ফিরে যেতো এবং একটা সময় তারা নিজেরাই বুঝতে পারলো যে আসলেই এটা একটা রং নাম্বার থেকে ফোন এসেছিলো।
রং নাম্বার থেকে ফোন আসার বিব্রতকর ঘটনা এই দুই তিন ঘটনায় সীমাবদ্ধ নয়। সব ঘটনা মনে নেই তারপরও যেগুলো মনে আছে সেগুলো একটা একটা করে বলতে গেলে এক টানা এক সপ্তাহ লাগবে। যাপিত জীবনের এইসব খন্ড খন্ড বিব্রতকর ঘটনা গুলো আড়ালেই থাক, এবার আমি অপেক্ষায় আছি একটা কাঙ্ক্ষিত রং নাম্বার থেকে ফোন এসে আমাকে আনন্দে ভাসিয়ে দিবে বলে। আমি প্রায়ই ভাবি কোন এক ভোরে আমার ঘুম ভাংবে একটা রং নাম্বার থেকে ফোন এসে। ফোনের অপর প্রান্তে যিনি থাকবেন তিনি স্বয়ং আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি তার মন্ত্রী সভার বিশ্বস্থ কোন এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর ফোনে ফোন করেছেন কিন্তু নাম্বার ভুল হয়ে যাওয়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কলটা আমার ফোনে চলে এলো। আমি ফোনটা রিসিভ করেছি কিন্তু আমাকে হ্যালো বলার সুযোগ না দিয়েই তিনি বলতে শুরু করলেন... বয়স ত অনেক হলো আর ক'দিনই বা বাঁচবো, এবার সত্যিকার অর্থেই দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য বসবাস যোগ্য একটা দেশ রেখে যেতে চাই। এমন একটি দেশ গড়তে চাই যে দেশে কোন রকমের দূর্নীতি থাকবেনা, যেসব দূর্নীতিবাজ লোক আছে তাদেরকে ধরে ধরে অপরাধ অনুসারে দৃষ্টান্তমূলক সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, বোমাবাজি, গুম, ইভ টিজিং, নারী নির্যাতন, ঘুষের লেনদেন, মারা-মারি, জ্বালাও-পোড়াও, অবরোধ আন্দোলন কোন কিছুই থাকবে না। শিক্ষাঙ্গন থাকবে সম্পুর্ণ সন্ত্রাস, রাজনীতি ও সেশন জট মুক্ত, ছাত্র ও শিক্ষকদের জন্য রাজনীতি থাকবে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য থাকবে সাধারণ মানুষের ক্রয়-ক্ষমতার মধ্যে, যাতে কেউ আর অনাহারে অর্ধাহারে না থাকে। দেশে কোন বিদ্যুৎ ঘাটতি থাকবে না, থাকবেনা কোন লোডশেডিং নামক যন্ত্রণা। পুলিশের আচরণ থাকবে মার্জিত, তারা যেন সত্যিকার অর্থেই জনগণের বন্ধু হয়ে জনগণের পাশে থাকে। বিচার ব্যবস্থা থাকবে সম্পূর্ণ স্বাধীন, যেকোন ধরনের মামলা সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি হবে। শিশু শ্রম থাকবেনা, উন্নত বিশ্বের মতোই শিশুদের মৌলিক চাহিদার সবটুকুই সরকার বহন করবে। দেশে কোন বেকার থাকবেনা, শিক্ষিত, আধা শিক্ষিত ও অশিক্ষিত বেকারদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয়া হবে। দেশের কোথাও ভাঙ্গা-চোরা বা চলাচলের অনুপোযোগী কোন রাস্তা ঘাট থাকবেনা, থাকবেনা রাস্তায় কোন জ্যাম... আমি শুনেই যাচ্ছি, শুনতে শুনতে আনন্দে আমার চোখে পানি চলে এসেছে। অপর প্রান্তে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আরোও অনেক কিছুই বলে যাচ্ছেন, বলতে বলতে হঠাৎ একসময় লাইনটা কেটে যায় কারণ ততক্ষণে আমার মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে গেছে...
জবরুল আলম সুমন
সিলেট।
১১ই মে ২০১২ খৃষ্টাব্দ।
রাস্তায় বেরুলে দেখা যেত অনেকেই কায়দা করে মোবাইল সেটটা হাতে নিয়ে হাঁটতেন যাতে আশ পাশের লোকজন দেখতে পারে যে অতি গুরুত্বপূর্ণ কেউ একজন একখান মোবাইল হাতে নিয়ে হাঁটছেন অনেকেই তখন ব্যক্তির দিকে না তাকিয়ে তার হাতে থাকা মোবাইল ফোনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো আর মনে মনে হয়তো নিজেকে ভর্ৎসনা করতো কেন সে এখনো একটা মোবাইলের গর্বিত মালিক হতে পারেনি বা কবে সে ঠিক এরকম একটা মোবাইল ফোনের মালিক হবে। সেসময় অবশ্য মোবাইল ফোন মালিকদের বিড়ম্বনা নেহায়েত কমও ছিলো না, তখনকার সময়ে সবচে সস্তা দামের হ্যান্ডসেটসহ এক একটা সংযোগ কিনতে কম করে হলেও পঁচিশ হাজার টাকা গুণতে হতো তাও একদিনে হতো না, ডাউন পেমেন্টে অর্ডার দিতে হতো আর ক'দিন পর পর খোঁজ নিতে হতো সংযোগ এলো কিনা। অবশেষে কাঙ্ক্ষিত সংযোগ নেয়ার পর মাস শেষে ৫/৬ হাজার টাকার বিল দেখে অনেকেই জ্ঞান হুশ হারিয়ে ওজু করে তওবা করেছেন বাকি জীবনে আর মোবাইল নামক যন্ত্রটা ছুঁয়েও দেখবেন না।
কেনা কাটার সাথে কোথায় যেন দেউলিয়া হওয়ার একটা বিশেষ যোগসূত্র আছে। অনেকেই হয়তো কেনা কাটা করে দেউলিয়া হয়েছেন বলে সৈয়দ মুজতবা আলী বাধ্য হয়ে বা কিছুটা আক্ষেপ করে লিখেছিলেন "বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয়না"। বই কিনে যেমন কেউ দেউলিয়া হয়না তেমনি একটা মোবাইল কিনেও কেউ দেউলিয়া হয়না তবে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে করে অনেকেই দেউলিয়া হয়ে গেছে। এ ব্যপারে এই মুহুর্তে আমার একটা ঘটনা মনে পড়ছে। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু সঙ্গত কারণে নাম প্রকাশ করছিনা। তার বাবা বিরাট বড় লোক। কিন্তু সে তার বাবার কাছ থেকে খুব বেশি টাকা পয়সা আদায় করতে পারতোনা। তাই আমরা প্রায়ই তাকে বড় লোক বাপের গরিব সন্তান বলে ক্ষেপাতাম। সেই সাথে তাকে আমরা বগুড়া (বক পাখির সিলেটী ভার্সন) বলে ডাকতাম উচ্চতায় সে আমাদের বন্ধু মহলের সবাইকে টপকে গিয়েছিলো বলে, ছ'ফুটের উপরে তার মাথার অবস্থান। দীঘে সবাইকে ছাড়িয়ে গেলেও প্রস্থে সুবিধা করতে পারেনি বেচারা। বাঁশের সাথে তার দারুণ মিল রয়েছে, দীঘে বাঁশের কাছা কাছি হলেও শরীরটাও ঠিক বাঁশের পাতার মতোই চিকন চাকন। গার্ল ফ্রেন্ড জুটিয়েছিলো দুই তিনটা কিন্তু কাউকে নিয়েই রিক্সায় চড়তে পারেনি ভালো মতো। রক্ষণশীল সমাজ বলেই সিলেটে সাধারণত কোন মেয়ে রিক্সায় থাকলে হুড তুলতে হয় কিন্তু সে যখন তার গার্ল ফ্রেন্ড নিয়ে রিক্সায় চড়ে তখন রিক্সায় হুড তোলা হলে তার গলাটা বকের মতোই বেরিয়ে আসতো, যেকারো নজরে পড়ার মতো ঘটনা বটে। পথচারীদের অনেকেই হা করে তাকিয়ে থাকতো পরিচিতদের মধ্যে কেউ কেউ টিপ্পনি কাটতো গলার উপরের বাড়তি অংশটা করাত কলে গিয়ে কেটে ফেললেই ত ঝামেলা চুকে যায় তাহলে আর এতো কষ্ট করতে হতো না।
এসব অশ্রাব্য মন্তব্যে অবশ্য তার কিছু যায় আসেনা, বন্ধু মহলে এধরনের কথা শুনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। যাহোক, বেশ কিছু দিন থেকে সে তার বাবার কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করতো একটা মোবাইল ফোন কিনে দেবার জন্য, কিন্তু তার বাবা কোন ভাবেই রাজি হচ্ছিলেন না। এদিকে আমাদের বন্ধুদের প্রায় সবাই মোবাইলের মালিক বনে গেছে। আমি অবশ্য এই ক্ষেত্রে সবার থেকে অগ্রজ কারণ আমি ঢাকায় থাকতাম বলেই মোবাইল আগেই কিনে নিয়েছি, সিলেটে সম্ভবত মোবাইলের নেটওয়ার্কের অন্তর্ভূক্ত হয়েছে ২০০০ সালের মাঝা-মাঝি বা শেষের দিকে। যাহোক, অবশেষে সে তার বাবাকে ফুসলিয়ে একটা মোবাইল ফোন আদায় করে নেয়। কিন্তু সে কাউকেই ফোন করতো না, মিসড কলের মধ্যেই তার ফোন সীমাবদ্ধ ছিলো তখন অবশ্য প্রতিমিনিট কল চার্জ ছিলো ৭টাকা কল না করে মিসড কল দেয়ার এটাও একটা কারণ ছিলো। একটু পর পর আমাকে মিসড কল দিয়ে জ্বালিয়ে মারতো, কাউকেই সে রেহাই দিত না।
একটা সময় তার মিসড কলে আমরা বিরক্ত হয়ে তার নাম 'মিসকল' রাখি! আমাদের বন্ধু মহলে সে তখন মিসকল নামেই সমধিক পরিচিত। একদিন তার মোবাইলে এক অপরিচিত নাম্বার থেকে মিসড কল আসে। কিন্তু সে কল ব্যাক না করে তাকেও মিসড কল দেয় বিপরীত ফোন থেকে আবারো মিসড কল আসে সেও যথারীতি কল না দিয়ে মিসড কল দিয়ে যাচ্ছে। তাদের মিসড কল মিসড কল খেলা বেশ ক'দিন চলো। তারপর একদিন আমরা সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছি ঠিক তখনী বিপরীত ফোন থেকে মিসকলের মোবাইলে একটা এস.এম.এস এলো "Apni eto kipta keno? Ekta call dite paren na?" হয়তো আমরা তখন সামনে ছিলাম বলেই মিসকলের গায়ে লাগলো এস.এম.এস-এর কথাটা। কিছুটা চেঁচিয়ে উঠে কল ব্যাক করে কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে কল রিসিভ করা হচ্ছেনা, কিন্তু সমান তালে মিসড কল দিয়ে যাচ্ছে। মিসকলও থেমে নেই সেও কল করে যাচ্ছে অনবরত, একটা সময় কলটি রিসিভ হয়। কিন্তু এ্যাঁ কি মিসকল এভাবে মোমের মতো গলে গলে পড়ছে কেন ? রহস্যটা উদ্ঘাটন করতেই আমরা সবাই মিসকলের মোবাইলে কান লাগাই, মিসকল তখনো কথা বলে যাচ্ছিলো। অপর প্রান্তে সুকন্ঠী কোন এক মেয়ের কন্ঠ আমরা শুনতে পেলাম, মিসকল তখন তার মোবাইল নিয়ে কথা বলতে বলতে আমাদের আড়ালে চলে গেলো।
মিসকলের সাথে এখন ওই সুকন্ঠী মেয়েটার দারুণ ভাব! ভাব বললে ভুল হবে, যা হবার হয়ে গেছে... হুম প্রেম! মাত্র দু'দিনের মধ্যেই মনের লেন-দেন হয়েই গেলো। মিসকল প্রেমে পড়ায় আমাদের একটা লাভ হলো কারণ সে এখন আর আমাদের জ্বালাতন করেনা আগের মতো। সন্ধ্যে বেলা নিয়মিত আমাদের আড্ডায় এলেও সে তার মোবাইল টিপাটিপিতেই ব্যস্ত থাকে, মানে এস.এম.এস-এর আদান প্রদান হচ্ছে। আমরাও তাকে খুব বেশি ঘাঁটাইনা, প্রেম করছে করুক। প্রেম মানুষের মৌলিক অধিকার না হলেও ব্যক্তিগত অধিকার বলে আমি মনে করি আর প্রতিটা মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত একটা জীবন আছে কারো ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করা উচিত না। এদিকেও আমিও ঢাকায় ফিরে গেছি আমার কর্মস্থলে। কিন্তু আমি প্রতি মাসের ২৫ তারিখে সিলেটে যেতাম আর ১ তারিখে ঢাকায় ফিরতাম। তাদের প্রেম তখন তুঙ্গে, তখন মোবাইলে এফ.এন.এফ এর কোন ব্যবস্থা ছিলোনা, প্রতিটা নাম্বারেই একই কল রেট প্রযোজ্য। ফলে প্রতি মিনিট ৭টাকা করে কথা বলা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়তো বিশেষ করে প্রেমের ক্ষেত্রে। কিন্তু প্রেমের কথা বার্তা অল্পতে কিছু হয়না, প্রেমে অল্প বলে কোন শব্দ নেই যা আছে তার সব বেশি বেশি। তিন'শ টাকার কার্ড রিচার্জ করে মাত্র ৪৩মিনিটের কথায় ব্যালেন্স ফুরিয়ে যেত!
তার জমানো হাজার দশেক টাকা ছিলো সবটাই মাত্র অল্প ক'দিনের মধ্যেই চেটেপুটে গ্রামীণ ফোনকে খয়রাত করে দিয়েছে প্রেম টিকিয়ে রাখতে। কিন্তু এখন কি করবে বেচারা, তিন'শ টাকার নীচে রিচার্জ করারও কোন সুযোগ ছিলো না তখন। বন্ধুদের কাছে হাত পাতা শুরু হয়ে গেলো, বন্ধুরাও নিরাশ করেনি তাকে। অনেকটা চাঁদা তুলে তুলে তার প্রেম টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। প্রতিদিন তিন'শ টাকা ! এর মধ্যে বাবা মায়ের কাছ থেকে কসরত করে যা খসাতে পারতো তা বাড়তি কথা বলার জন্য। বন্ধুরা মিলে আরোও এক মাসে মতো চালালাম। কিন্তু আর কত ? আমাকে তখন প্রায়ই ফোন করতো আমি সময় সুযোগে তাকে কার্ডের নাম্বার পাঠিয়ে দিতাম। আরোও কিছুদিন পর বন্ধুরা সাহায্যের হাত প্রায় গুটিয়ে নিলো। আমিও তখন বিশেষ কাজে মাস দেড়েকের জন্য কলকাতায় চলে গেলাম। কলকাতা থেকে ফিরে এসে শুনলাম, অন্যান্য বন্ধুরা সাহায্যের হাত পুরোপুরি বন্ধ করে দিলে সে খুব বিমর্ষ হয়ে পড়ে। বাবা মায়ের কাছে চেয়েও পর্যাপ্ত টাকা না পেয়ে শেষে একে একে তার শখের ক্যামেরা, পোর্টেবল ডিভিডি প্লেয়ার, প্লে ষ্টেশন, গলার স্বর্ণের চেইন বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয় এরই মধ্যে দুই একটা বিক্রিও করে দিয়েছে। আমি তাকে অনেক বারণ করেছি সাধ্যমত সাহায্য করে। কিন্তু সে আমার কথা শোনেনি। একে একে তার সব কিছুই বিক্রি করতে থাকে। একটা সময় তার প্রেমিকা তাকে চাপ দেয় দেখা করার জন্য, কিন্তু কিভাবে দেখা করবে তার হাতে তেমন টাকা পয়সা নেই। কিন্তু তাতে তার খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা নয়, কারণ তার প্রেমিকার অবস্থান ঢাকায়। আমিও ঢাকায় থাকি, সুতরাং তার তেমন খরচা নেই যেহেতু আমি ঢাকায় আছি। তাকে বললাম তুই কোন রকমে চলে আয় বাকিটা আমি দেখবো।
সে পাঁচ সাত দিনের মধ্যেই ঢাকায় চলে এলো, আমি তখন ভীষণ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছি আমার পেশাগত কারণেই। গুলশানের একটা রেষ্টুরেন্টে তারা দেখা করবে বলে ঠিক করেছে, আমাকে অনেক অনুরোধ করলো তার সাথে থাকার জন্য কিন্তু আমি ষ্টুডিও নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তার সঙ্গে যেতে পারিনি। তাকে আমি কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিউ ইস্কাটন থেকে ট্যাক্সিতে তুলে দিয়ে আমি ষ্টুডিওতে চলে যাই, পথি মধ্যে সে আমাকে বার দুয়েক ফোনও করে। কথা ছিলো সে গুলশানের ওই রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ সেরে মগবাজারে চলে আসবে, তার আসতে আসতে তিন চারটা বাজবে। সেই সাথে তাকে আমি আমার রুমের চাবিটা দিয়ে দিই যদি সে সময়ের আগে চলে আসে তবে যেন রুমে বসে বিশ্রাম নেয়। তিনটা বাজে, চারটা বাজে তার আসার নাম নেই। পাঁচটার দিকে আমি তার মোবাইলে ফোন দিই, কিন্তু এ্যাঁ কি! তার ফোন অফ!! আমি বার বার তার মোবাইলে ফোন করতে থাকি কিন্তু ফোন আর ওপেন করছেই না। আমি কিছুটা রেগে যাই, শালা প্রেমিকা পেয়ে আমাকে ভুলে গেছে। ছ'টা পর্যন্ত তাকে আমি ফোন দিই কিন্তু নাহ ফোন এখনো অফ করেই আছে। আমি ষ্টুডিও থেকে বাসায় ফিরে আসার জন্য তৈরী হচ্ছি, রাতে আবারো ষ্টুডিওতে আসতে হবে কারণ রাত দশটার দিকে প্রথম সারির নামকরা একজন আর্টিস্টের রেকর্ডিং আছে তিনি আমাকেই চাইছেন তার শিফটে। আমি বাসায় ফিরে প্রায় আঁৎকে উঠি, রুমের দরজার ভেতর থেকে বন্ধ! আমি দরজায় বার কয়েক নক করার পর মিসকল দরজা খোলে। তার মলিন মুখ দেখেই বুঝে নিলাম কোন গন্ডগোল হয়েছে। আমি তখন তাকে বললাম, কিরে ফোন অফ করে রেখেছিস কেন ? তুই আমাকে একটা কল করে বলতে পারতি যে তুই চলে এসেছিস, আমাকে আর এতো টেনশান করতে হতো না। কিন্তু সে কোন কথা-ই বলছেনা। অনেক সাধা সাধির পর যা বললো তা শুনে আমার মাথা ঘুরে এলো। এমনও হয় !!!
গুলশানের নির্ধারিত ওই রেষ্টুরেন্টে তাদের দেখা হয়। মেয়েটা মোটামোটি সুন্দরী (তার ভাষায়)। প্রথমে হাল্কা কিছু খাবারের অর্ডার দেয়া হয়। খেতে খেতে মিনিট দশেক কথার পর হঠাৎ মেয়েটার মোবাইলে একটা কল আসে। মেয়েটি তখন মিসকলকে বলে তোমার মোবাইলে কি টাকা আছে, আমার একটা জরুরী ফোন আছে দুই চার মিনিট কথা বলতে হবে। মিসকল তখন হাসিমুখে তার মোবাইল মেয়েটার হাতে ধরিয়ে দেয়, মেয়েটি তখন ৩০ সেকেন্ডের মতো কথা বলে লাইনটা কেটে দেয় তারপর মিসকলকে বলে ফোনের রিসিপশানে সমস্যা করছে তুমি একটু বসো আমি জরুরী কথাটা সেরে নিই, তখন মেয়েটি আবারো মিসকলের মোবাইল থেকে কল দিয়ে হ্যালো হ্যালো বলে রেষ্টুরেন্টের বাইরে চলে যায়। মেয়েটি সেই যে বাইরে গেলো আর ফিরে এলো না। মিসকলের মোবাইল নিয়ে উধাও হয়ে গেলো। প্রেমিকা, মোবাইল, জমানো টাকা শখের জিনিষপত্র হারিয়ে মিসকল পাথর হয়ে গেছে, তার চোখের কোণা দিয়ে অশ্রু ঝরতে দেখে আমার চোখেও অশ্রু আসার যোগাড়, নিজেকে সামলে নিলাম কোন ভাবে। সময় বসে থাকেনা চলতেই থাকে, সময়ের ঘূর্ণিপাকে আজ এই ঘটনা কেবলি স্মৃতি। মিসকল এখন আর আমাকে মিসড কল দেয় না, কলই দেয়। প্রত্যেক মাসে দুই একবার করে কল দেয়, বর্তমানে সে দুই বাচ্চা আর বউ নিয়ে লন্ডনের এসেক্সে বিশাল একটা বাড়িতে থাকে। সম্প্রতি তার সাথে আমার কথা হয়েছে এই ঘটনাটি তখন মনে পড়েগিয়েছিলো খুব হেসেছিলাম ঘটনাটি বলতে বলতে।
ফোন ব্যবহার করছেন অথচ রং নাম্বার থেকে কল আসেনি এমন কোন ব্যবহারকারী হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবেনা। রং নাম্বার থেকে পরিচয় অতঃপর প্রেম পর্ব সেরে ঘর সংসার করা জুটির অভাব নেই আমাদের দেশে। ২০০৫ থেকে নিয়মিত কিছু মানুষ আমাকে ফোন করে রঙ মিস্ত্রী বেলালের খোঁজ করতো। কারণ বেলাল নামের কোন এক রঙ মিস্ত্রী তার ভিজিটিং কার্ডে ভুলক্রমে আমার নাম্বারটা ছাপিয়ে দেয়। কিন্তু সে আর নাম্বারটা সংশোধন না করেই মানুষজনকে কার্ড বিতরণ করতে থাকে, ফলে প্রায়শই তার ঝামেলা আমাকে সামাল দিতে দিতো। রং নাম্বার থেকে ফোন এসে সবচে মজার কান্ডটি ঘটেছে বছর তিন আগে, মধ্য বয়স্ক একজন মহিলা আমাকে ফোন করেছেন কিন্তু আমাকে হ্যালো বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি এক নাগাড়ে বলেই চলেছেন... "বাবাজি, মেয়েটা আমার খুবই অবুঝ কতই বা আর বয়স এখনো ভালো মন্দ বুঝতে শেখেনি। আমি জানি তার এভাবে রাগ করে চলে আসাটা ঠিক হয়নি কিন্তু আগেই ত বললাম ও একটা অবুঝ, ওর যদি কান্ড জ্ঞান থাকতো তাহলে কি এভাবে একটা দুধের বাচ্চা রেখে ফেলে আসতো ? বাবাজি আপনি কিছু মনে করবেন না। শাকিল বাড়িতে নেই ও ঢাকায় গেছে এ্যাম্বেসিতে কাগজ পত্র জমা দিতে ও যদি বাড়িতে থাকতো তাহলে ওকে দিয়েই আমি নাসিমা-কে পাঠিয়ে দিতাম। তোমার শ্বশুড়ও খুব অসুস্থ্য নইলে তিনিই নাসিমা'কে পৌছে দিয়ে আসতেন। তাই রাগ গোস্যা না করে কাল আপনিই চলে এস নাসিমা'কে নিয়ে যাবেন"
এই পর্যায়ে আমি ওই ভদ্র মহিলাকে থামালাম বললাম আপনি ভুল নাম্বারে ফোন করেছেন আমি আপনার মেয়ের জামাই নই, কিন্তু তিনি আমার কথা শুনতে নারাজ, একা একা বলেই চলেছেন। এক পর্যায়ে আমি লাইনটা কেটে দিই, একটু পর আবারো কল আসে ওই নাম্বার থেকে। আমি ধরলাম, যথারীতি হ্যালো বলার আগেই মহিলার কন্ঠ "বাবা দয়া করে আর রাগ করবেন না, মানুষ ভুল করে আবার মানুষই তার সংশোধন করে ও একটা ভুল করে ফেললো তাই বলে আপনি কি তাকে সংশোধন করে দিতে পারেন না ? ঝগড়া ঝাটি আপনারা করেছেন কিন্তু মাঝ পথে বাচ্চাটা কষ্ট পাচ্ছে, অন্তত বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে ওকে ক্ষমা করে দিন" আমি আবারো মহিলাটিকে থামালাম বললাম আন্টি আপনি আসলে ভুল নাম্বারে ফোন করেছেন আপনি যাকে ভেবে ফোন করেছেন আমি সেই জন না, তিনি আবারো আমাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে নানান কথা বলতে শুরু করেছেন। আমি বাধ্য হয়ে আবারো লাইনটি কেটে দিই, কিন্তু মহিলাটি নাছোড় বান্দা আবারো কল করেন আমি আর রিসিভ করিনি, এরপর তিনি আরোও কয়েক বার কল দিয়েছিলেন কিন্তু আমি কল রিসিভ না করে কয়েক ঘন্টার জন্য ফোনটাই অফ করে দিই।
আরো একবার অন্য একটা রং নাম্বার থেকে ফোন এসে আমার পারিবারিক মান-সম্মানের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিলো। আমি তখন আমার ফোনটা আমার বেড রুমে রেখে কোন একটা জিনিষ কিনতে পাশের দোকানে গেছি ততক্ষণে আমার মোবাইলে একের পর কল আসতে শুরু করে, আমার ফোন সাধারণত অন্য কেউ রিসিভ করেনা। কিন্তু এক নাগাড়ে ফোন বাজতে দেখে আমার ছোট ভাই কলটি রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে অভিমান ভরা কন্ঠে বলতে লাগলো "তুমি এখনো আসছো না কেন ? সেই কখন থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি, বাংলালিংকটা অফ করে রাখছো কেন ? ভেবেছিলাম আজ সারাদিন তোমাকে নিয়ে রিক্সায় ঘুরবো কিন্তু সারাটা দিন ত তোমার অপেক্ষাতেই চলে যাচ্ছে আর কত অপেক্ষা করাবে ?" শেষ লাইনটিই আমার ছোট ভাইয়ের জন্য যথেষ্ট ছিলো ওই অভিমানী মেয়েটার সাথে আমার কি সম্পর্ক তার নির্ণয় করতে। "ভাইয়া বাইরে গেছে আপনি পাঁচ মিনিট পরে তাকে ফোন দিন" আমার ছোট ভাইয়ের কথা শেষ করতে না করতেই অপর প্রান্ত থেকে কলটি কেটে দেয়। আমি ঘরে ফিরে এসেছি, কিন্তু কোথাও বের হচ্ছিনা দেখে একটু পর পর আমার ছোট ভাইটা আমার ঘরের আশ পাশে সন্দেহ জনক ভাবে ঘুর ঘুর করতে লাগলো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম কিরে কি হয়েছে ? সে আমাকে কিছু না বলেই চলে গেলো। আমি সারাদিন বাসাতেই ছিলাম কোত্থাও আর বের হইনি।
সন্ধার দিকে সাধারণত আমি আড্ডা দিতে বের হই বন্ধুদের সাথে, তেমনি সেদিন আড্ডা শেষ করে ঘরে ফিরেই দেখি আমার জন্য পারিবারিক পার্লামেন্ট বসেছে, সবাই গোল হয়ে ড্রয়িং রুমে ফ্লোরে বসে আছে। স্পিকারের দায়িত্বে আছেন আমার মা, বাকিরা সবাই আমার বিরোধী দল। অবশ্য এই সংসদে আমার বাবা আর বড় ভাই অনুপস্থিত। আমি বাসায় ফিরতেই মা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন কিরে মেয়েটা কে, বাড়ি কোথায় ? আমি তাৎক্ষনিক ভাবে কিছু বুঝতে না পেরে পাল্টা প্রশ্ন করলাম কোন মেয়েটা ? অন্য সবাই তখন চোখ ট্যারা করে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে মা তখন গলার স্বর কিছুটা বিকৃত করে বললেন আর ভান করতে হবেনা আমরা যা জানার জেনে গেছি, এবার চট করে বল কে ঐ মেয়ে ? আমি অনেকটা অসহায়ের মতো বললাম মা তোমরা কি জানতে চাচ্ছো আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। আমার ছোট ভাইটা তখন বলে উঠলো দুপুরে তুমি যখন বাইরে ছিলে তখন তোমার লাভার ফোন করেছিলো আমি ফোনটা রিসিভ করি। এবং মেয়েটি কি বলেছিলো তাও ভেংচি কেটে বললো। আমি আঁৎকে উঠি, আমার লাভার !! বলে কি ওরা... আমি সাথে সাথে আমার ফোনের কল লিষ্ট বের করে দেখলাম অপরিত একটা নাম্বার থেকে তখন আমার মোবাইলে ফোন এসেছিলো। কিন্তু ওই মেয়েটি আমাকে পরে আর ফোন করেনি তাই বিষয়টা আমার জানা ছিলো না।
আমি বললাম এটা একটা রং নাম্বার ছিলো কিন্তু কেউ বিশ্বাস করতে চাচ্ছেনা দেখে আমি লাউড স্পিকার অন করে ওই নাম্বারে কল ব্যাক করলাম। ফোনটা রিসিভ করতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম এই নাম্বার থেকে দুপুরে আমার মোবাইলে একটা কল এসেছিলো সেটা কি আপনি করেছিলেন ? তখনি ওই মেয়েটা বললো সরি ভাইয়া আসলে একটা ডিজিট ভুল করে ফেলায় আপনার নাম্বারে চলে গিয়েছিলো আই এ্যাম এক্সট্রিমলি সরি ফর দ্যাট। আমি তখনি আচ্ছা ঠিক আছে বলে ফোনটা কেটে দিলাম। কিন্তু তারপরও কাউকে বিশ্বাস করানো যাচ্ছে না, সবাই ভাবছে এটা আমাদের পরিকল্পিত। বেশ কিছু দিন সবার সন্দেহের তীর আমার দিকে ছিলো, আমার কোন ফোন আসলেই দরজার ওপাশে গোয়েন্দাদের আনা গোনা টের পেতাম আমি ফোনটা ছেড়ে দিলে তারা পরাজিত সৈনিকের বেশে ফিরে যেতো এবং একটা সময় তারা নিজেরাই বুঝতে পারলো যে আসলেই এটা একটা রং নাম্বার থেকে ফোন এসেছিলো।
রং নাম্বার থেকে ফোন আসার বিব্রতকর ঘটনা এই দুই তিন ঘটনায় সীমাবদ্ধ নয়। সব ঘটনা মনে নেই তারপরও যেগুলো মনে আছে সেগুলো একটা একটা করে বলতে গেলে এক টানা এক সপ্তাহ লাগবে। যাপিত জীবনের এইসব খন্ড খন্ড বিব্রতকর ঘটনা গুলো আড়ালেই থাক, এবার আমি অপেক্ষায় আছি একটা কাঙ্ক্ষিত রং নাম্বার থেকে ফোন এসে আমাকে আনন্দে ভাসিয়ে দিবে বলে। আমি প্রায়ই ভাবি কোন এক ভোরে আমার ঘুম ভাংবে একটা রং নাম্বার থেকে ফোন এসে। ফোনের অপর প্রান্তে যিনি থাকবেন তিনি স্বয়ং আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি তার মন্ত্রী সভার বিশ্বস্থ কোন এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর ফোনে ফোন করেছেন কিন্তু নাম্বার ভুল হয়ে যাওয়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কলটা আমার ফোনে চলে এলো। আমি ফোনটা রিসিভ করেছি কিন্তু আমাকে হ্যালো বলার সুযোগ না দিয়েই তিনি বলতে শুরু করলেন... বয়স ত অনেক হলো আর ক'দিনই বা বাঁচবো, এবার সত্যিকার অর্থেই দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য বসবাস যোগ্য একটা দেশ রেখে যেতে চাই। এমন একটি দেশ গড়তে চাই যে দেশে কোন রকমের দূর্নীতি থাকবেনা, যেসব দূর্নীতিবাজ লোক আছে তাদেরকে ধরে ধরে অপরাধ অনুসারে দৃষ্টান্তমূলক সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, বোমাবাজি, গুম, ইভ টিজিং, নারী নির্যাতন, ঘুষের লেনদেন, মারা-মারি, জ্বালাও-পোড়াও, অবরোধ আন্দোলন কোন কিছুই থাকবে না। শিক্ষাঙ্গন থাকবে সম্পুর্ণ সন্ত্রাস, রাজনীতি ও সেশন জট মুক্ত, ছাত্র ও শিক্ষকদের জন্য রাজনীতি থাকবে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য থাকবে সাধারণ মানুষের ক্রয়-ক্ষমতার মধ্যে, যাতে কেউ আর অনাহারে অর্ধাহারে না থাকে। দেশে কোন বিদ্যুৎ ঘাটতি থাকবে না, থাকবেনা কোন লোডশেডিং নামক যন্ত্রণা। পুলিশের আচরণ থাকবে মার্জিত, তারা যেন সত্যিকার অর্থেই জনগণের বন্ধু হয়ে জনগণের পাশে থাকে। বিচার ব্যবস্থা থাকবে সম্পূর্ণ স্বাধীন, যেকোন ধরনের মামলা সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি হবে। শিশু শ্রম থাকবেনা, উন্নত বিশ্বের মতোই শিশুদের মৌলিক চাহিদার সবটুকুই সরকার বহন করবে। দেশে কোন বেকার থাকবেনা, শিক্ষিত, আধা শিক্ষিত ও অশিক্ষিত বেকারদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয়া হবে। দেশের কোথাও ভাঙ্গা-চোরা বা চলাচলের অনুপোযোগী কোন রাস্তা ঘাট থাকবেনা, থাকবেনা রাস্তায় কোন জ্যাম... আমি শুনেই যাচ্ছি, শুনতে শুনতে আনন্দে আমার চোখে পানি চলে এসেছে। অপর প্রান্তে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আরোও অনেক কিছুই বলে যাচ্ছেন, বলতে বলতে হঠাৎ একসময় লাইনটা কেটে যায় কারণ ততক্ষণে আমার মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে গেছে...
জবরুল আলম সুমন
সিলেট।
১১ই মে ২০১২ খৃষ্টাব্দ।
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন