সাবধান মিসেস মূখার্জী...

দৃশ্য একঃ
ষোল বছরের এক বাড়ন্ত কিশোরী। শরীরের সাথে পাল্লা দিয়ে মনের বিশালতাও বাড়ছে ক্রমে ক্রমে। সদ্য ফেলে আসা শৈশবের স্মৃতিতে কৈশোরের স্বপ্ন স্থলাভিষিক্ত হচ্ছে রোজ রোজ। পরিবার কর্তা কর্ত্রীদের শাসনের বেড়াজালও সম্প্রসারিত হচ্ছে প্রতি নিয়ত তবুও স্বপ্ন বুনাতে কোন ভাটা পড়েনা। চিরচেনা চারপাশটাকে প্রতিদিনই নতুন মনে হয় নতুন নতুন অনুভূতির আগমনে। টেলিভিশনের পর্দায় নায়ক-নায়িকার আনন্দঘন মুহুর্তে আনমনে নিজেকেই বসিয়ে দেয় নায়িকার পাশে। স্কুলের ক্লাসে পাশের বেঞ্চে বসা সব গুলো ছেলেকে এক এক করে নিজের মনে টেনে এনে পরীক্ষা চালায় কোন ছেলেটি তার জন্য যুৎসই।
কখনো আনমনেই লজ্জায় হেসে উঠে বারবার। খাতার পাতায় লুকিয়ে লুকিয়ে লেখা নামের সাথে মাথায় লালন করা নামটা বেশীর ভাগ সময় মিলছেনা বলে দুঃশ্চিন্তার অন্ত নেই। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের শারীরিক পরিবর্তন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করলেও অপরিচিত কারো সামনে নিজের শরীরটাকে সতর্ক ভাবে ঢেকে রাখার প্রচেষ্টা থাকে নিরন্তর। প্রতিবেশী বাল্যবন্ধু ছেলেটার সাথে সময় অসময়ে দেখা করার ব্যপারটা অঘোষিত ভাবে নিষিদ্ধ হয়ে গেছে, তেমনি ভাবে নিকট বা দূর সম্পর্কিয় আত্মীয়ের সাথে কথা বলার সময় মায়ের সন্দেহের চাহনি খুব সহজেই ধরা পড়ে। বিকেলের আড্ডায় যোগ দিতে ছাদের উপরে কিংবা বাড়ীর আশ-পাশে যেতে অনেক বাধার সম্মূখীন হতে হয়। মনের ভেতরে লালন করা রঙ্গীন স্বপ্নগুলোকে অনেক সময় শাসনের অদৃশ্য হাত দিয়ে গলা টিপে হত্যা করা হলেও নতুন নতুন অনেক স্বপ্ন ঠিকই জন্ম নেয় ঠিক ঠিক করে বাজতে থাকা সময় ঘড়ির কাঁটার সাথে।

দৃশ্য দুইঃ (চব্বিশ বছর পর)
পরিবার কর্তা পরিবার চালানোর প্রয়োজনীয় রসদ যোগান দিতে বাইরে থাকবেন এটাই স্বভাবিক। তাই এই পরিবারকে আগলে রাখার কঠিন দায়িত্বভার গৃহকর্ত্রীর কাঁধে সওয়ার হয়। তিনি শুধুই একজন গৃহকর্ত্রীই নন তিনি এখন একজন মা, ষোল বছরের এক অবাধ্য কিশোরীর মা। ঘর-দোর সামাল দেবার পাশা পাশি তাকে এখন অনেক সতর্ক হয়ে থাকতে হয়। এই বাড়তি সতর্কতা বাড়ন্তী মেয়েটার জন্য। মেয়েটার ভাব ভঙ্গি বেশ সন্দেহ জনক ঠেকছে। ইদানিং সব সময় কিছু না কিছু লুকিয়ে রাখার প্রবণতা খুব করে পরিলক্ষিত হচ্ছে তাই তাকে এক মূহুর্তের জন্যও চোখের আড়াল করে রাখা যাবেনা কখন কি করে বসে কে জানে।

** প্রথম দৃশ্যে অভিনীত ষোল বছরের কিশোরীটি দ্বিতীয় দৃশ্যে মায়ের ভূমিকায়। সময়ের পালা বদলের সাথে সাথে মেয়েদের দায়িত্বও বদলে যায়। সময় এবং স্বপ্ন বদলে যাওয়ায় সেদিনের সেই কিশোরীটি আজকে গোটা পরিবারের দায়িত্বে নিয়োজিত। আবহমান কাল থেকে আমাদের সমাজের প্রতিটা পরিবারে এই দৃশ্যদ্বয়ের মঞ্চায়ন হয়ে আসছে। কালাতিক্রমে দুই একটা পরিবার এই দৃশ্যনাট্য থেকে সিঁটকে পড়লেও আমাদের সমাজের পরিবার গুলোর বৃহৎ একটা অংশ যে এই নাট্যচক্রের মধ্য দিয়েই যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

কান টানলে যেমন মাথা আসে ঠিক তেমনি জীবনমূখী বাংলা গান টানলে অবধারিত ভাবে নচিকেতা সুমনের নাম আসবেই। আর নচিকেতা সুমনের নাম এক সাথে উচ্চারণ করলে তাদের পাশে একটু করে হলেও অঞ্জন দত্তকে স্থান দিতেই হয়। বহুমূখী প্রতিভার অধিকারী অঞ্জন দত্তের অবদান জীবনমূখী বাংলা গানে নেহায়েত কম নয়। অঞ্জন দত্তের শুরুটা চলচ্চিত্র দিয়ে হলেও চল্লিশ বছর বয়সে এসে গীটার হাতে গানের ভূবন মাত করেন। এটা কি ২৪৪১১৩৯, রঞ্জনা আমি আর আসবো না, তুমি না থাকলে সকালটা এতো মিষ্টি হতো না, এই গান গুলোর মতো অনেক অনেক জনপ্রিয় গানের জনক তিনি। উপরের দৃশ্যপটগুলো তারই একটা গান থেকে আমি তুলে এনেছি। অঞ্জন দত্তের গান প্রথম কখন কোথায় শুনেছিলাম তা আর মনে নেই তবে তার গান শুনে যে সময়ের অপচয় করেছি তা কখনোই বলা যাবে না। শ্রোতাপ্রিয় অঞ্জন দত্তের গায়কীতে খুব বেশি পরিবর্তন না আসলেও তার প্রতিটা গানের কথা গুলোর পরিবর্তন প্রশংসার দাবী রাখে। অনেকেই তার গানের মধ্যে পশ্চিমের লুই আর্মষ্ট্রং, পিট সিগার, বব ডিলানের সাদৃশ্য বের করে তাকে এক হাত দেখে নেয়ার মতলব খোঁজে বেড়ান। তাদের দিকে আমার সবল তর্জনী উঁচিয়ে বলছি ফ্রেডারিক হ্যান্ডেল, ফ্র্যাঞ্জ শুবার্ট, লুই আর্মষ্ট্রং, ন্যাট কিং কোল, পিট সিগার বা বব ডিলানের কর্মের সাথে আমি পরিচিত। তাদের কৃত কর্মগুলো বা তাদের গাওয়া গানগুলো তাদের সমাজের জন্য প্রযোজ্য যা আমাদের বাঙ্গালী সমাজের সাথে খাপ খায়না। তবে তাদের ভাব ধারার সাথে মিল রেখে যদি আমাদের সমাজ উপযোগী কিছু গান উপহার দেয়া যায় তাতে ত কোন দোষের কিছু দেখছি না। আমাদের সমাজে কিছু মানুষ আগেও ছিলো এখনো আছে আর ভবিষ্যতেও থাকবে যারা কিছু করে দেখাতে পারবেনা আবার অন্যের ভালো কোন কর্মকেও সহজ ভাবে মেনে নিতে পারবেনা। মিসেস মুখার্জী তাদের থেকেও সাবধান !
আপনি যদি অঞ্জনের গানের সংগ্রাহক হয়ে থাকেন তবে কোন কথা নাই আর যদি না হয়ে থাকেন তবে তাদের জন্য উপরের দৃশ্যে বর্ণিত অঞ্জন দত্তের গাওয়া আমার অতি পছন্দের গানটা লিরিক সহ শেয়ার করলাম। আশা করি শুনলে সময়ের অপচয় হবেনা।

মিসেস মূখার্জী
- অঞ্জন দত্ত

সাবধান মিসেস মূখার্জী একটু ভেবে দেখবেন
মেয়েটি যে আপনার হচ্ছে বড় নয় ফাউন্টেন পেন,
আগলে আগলে রেখে আঁচলের তলায়-
ধরে রাখা যায়না সময়;
চোখে চোখে রাখা মানে কিন্তু মনে ধরে রাখা নয়।
সাবধান মিসেস মুখার্জী তাকিয়ে দেখুন একবার
বলতে কি চায় চোখ দুটো তার চাপা অহংকার,
জামার মাপটা তার জানেন ভালোই
মনের খবর কি রাখেন ?
সাবধান মিসেস মুখার্জী সাবধান মিসেস সেন।
বড় হয়ে যাচ্ছে বন (হাড়)
বড় বড় স্বপ্ন সে দেখতে শিখছে এখন
পৃথিবীটা তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে
মানবে কি করে সে বলুন
আপনার ছোট খাটো শাসন।

সময়ের মার নেই বলছি যে তাই এখনো সময় আছে
যতই তাকে আগলে রাখুন নাচ আর গানের ক্লাসে,
অন্ধ যে নয় তার চোখ দুটো তাই বন্ধ যে নয় তার মন
সেই মনের সাথে কত হাজার কথা হয় তার যখন তখন;
ষোল বছরের এই মনটার ভেতরে রোজ রোজ কত কি ঘটে
কত কত স্বপ্নকে জন্ম সে দেয় কত স্বপ্নকে দেয় পুড়িয়ে,
একদিন মনের এই শশ্মানটা যদি দাউ দাউ জ্বলে উঠে
সাবধান মিসেস মুখার্জী সাবধান মিসেস রে (রায়)।
বড় হয়ে যাচ্ছে মন
বড় বড় স্বপ্ন সে দেখতে শিখছে এখন
পৃথিবীটা তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে
মানবে কি করে সে বলুন
আপনার ছোট খাটো শাসন।

ন' নটা মাস ধরে পেটের ভেতরে নিয়ে হাজার যন্ত্রণা
একটু একটু করে একদিন আপনি হয়ে গেলেন মা,
একটু একটু করে যৌবন আপনার কোথায় গেলো হারিয়ে
স্বপ্ন দেখার সেই মনটাও কেমন হয়ে গেলো ঘোলাটে,
বদলে গেলো সময়টা নাকি আপনি বদলে গেলেন
ষোল বছরের সেই স্বপ্নগুলো আপনি ভুলে বসেছেন;
বলেই পারেন আমার এই গানের নেই কোন মূল্য মানে
তবে সাবধান মিসেস দত্ত সাবধান মিসেস রে (রায়)।
বড় হয়ে যাচ্ছে বন (হাড়)
বড় বড় স্বপ্ন সে দেখতে শিখছে এখন
পৃথিবীটা তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে
মানবে কি করে সে বলুন
আপনার ছোট খাটো শাসন।

জবরুল আলম সুমন
সিলেট।
১৬ই অক্টোবর, ২০১০ খৃষ্টাব্দ

সাবধান মিসেস মুখার্জী গানটা এখান থেকে ডাউনলোড করে শুনুন...

0 মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পোস্ট পুরাতন পোস্ট হোম

    আমার ব্লগে আপনাকে স্বাগতম

    নিজের লেখা দিয়ে নিজের মতো করে এই ব্লগটি সাজানোর চেষ্টা করেছি, আমার এই ব্লগটি যদি আপনাদের ভালো লাগে তবেই আমার এই শ্রম স্বার্থক হবে। ব্লগটি পরিদর্শন করার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

ব্লগটি আজ দেখা হয়েছে মোট

ইতিহাসের এই দিনে

Flickr Images

2014 © জবরুল আলম সুমন কর্তৃক. Blogger দ্বারা পরিচালিত.

এক ঝলকে আমি

আমার ফটো
নিজের সম্পর্কে বলার মত সঞ্চয় আমার নেই। নিজেকে স্বচ্ছ আয়নার মতই ভাবি, আমার প্রিয় বন্ধুরা যখন আমার সামনে এসে দাঁড়ায় আমি তখন তাদের প্রতিবিম্ব মাত্র। তাতেই আমার সুখ। গান শুনতে পছন্দ করি, পছন্দ করি লিখতে আর সময় সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ি অচেনা পৃথিবীটাকে চেনার জন্য।

এই ব্লগটি সন্ধান করুন


Recent Comments