যাকাতের কাপড় না মৃত্যু ফাঁদ ?

রমজান মাস এলেই ইফতারীর দোকানগুলোতে নানান রকমের ইফতারের পসরা সাজিয়ে দোকানীদের বসে থাকতে দেখা যায়। নানান রকম মুখোরোচক ইফতারীর পসরা যেমন পথচারীদের নজর কাড়ে তেমনি রমজান মাস এলেই আমারো ভিন্ন একটা বিষয়ে নজর কাড়ে আর তা হলো যাকাতের কাপড়। রাজধানী ঢাকা সহ সারাদেশের বড় বড় কাপড়ের দোকানগুলোতে লাল কাপড়ের ব্যানারে সাদা অক্ষরে লেখা "এখানে অতি সুলভে যাকাতের কাপড় পাওয়া যায়" এই বিজ্ঞাপনটি নিশ্চয় আমার মতো অনেকেরই নজর কাড়ে। কিন্তু কেউ কি আমাকে বলতে পারবেন যাকাতের কাপড় মানে কি ? গুণ ও মান বিবেচনা করে কাপড়ের বিভিন্ন শ্রেণী বিভাগ আছে। তাই কাপড়ের প্রস্তুতকারকেরা বিভিন্ন ধরনের কাপড় তৈরী করে নির্দিষ্ট কাপড়কে চিহ্নিত করণের জন্য কিছু ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়েছেন যেমনঃ কটন, সিল্ক, জর্জেট, মার্বল, গরদ, পলিয়েষ্টার, টেট্টন, ট্রপিক্যাল, উল, রেশমী, কাতান, মসলিন, টাঙ্গাইল, বেনারশী, তাঁত, গ্যাভাডিন, জিন্স, স্যুটের কাপড়, সার্টের কাপড় ইত্যাদি। কিন্তু "যাকাতের কাপড়" এই নামটা কিভাবে হতে পারে তা আমার মাথায় ধরেনা।

অনেককেই জিজ্ঞেস করলেও যাকাতের কাপড়ের সংজ্ঞা আর ব্যাখ্যা কেউ আমাকে সঠিক ভাবে বলতেও পারেননি। তাই নিজের বিবেচনা আর মোটা বুদ্ধির বদৌলতে যা নিজে নিজে বুঝতে সক্ষম হয়েছি তা হলো, যারা কাগজে কলমে হিসেব কষে কিংবা হাতের আন্দাজে যাকাত দিয়ে থাকেন তাদের একটা অংশ বাজারে গিয়ে যাকাতের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা সম্পূর্ণ বা আংশিক টাকা দিয়ে গরীব লোকজনদেরকে বিতরণ করার জন্য যেসব কাপড় ক্রয় করা হয় তাকেই যাকাতের কাপড় বলে। কার বা কাদের দ্বারা সেসব কাপড়ের নাম রাখা হয়েছিলো যাকাতের কাপড় তা জানা না গেলেও আমি সেই ছোট বেলা থেকেই দেখে আসছি এসব কাপড় চোপড়কে যাকাতের কাপড় বলে বিশেষায়িত করতে। কিন্তু কোন কাপড়কে যাকাতের কাপড় বলা হয় তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন ? সবচে নিকৃষ্ট সূতায় তৈরী, বাজারের সবচে সস্তা মূল্যের এবং মান ও গুণগত দিক দিয়ে সবচাইতে নিম্ন মানের শাড়ী ও লুঙ্গিকেই যাকাতের কাপড় হিসেবে ক্রয় করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ বাজারের সব নিকৃষ্ট মালই ফকির মিসকীনের প্রাপ্য। যাকাতের টাকা দিয়ে ভালো সূতায় তৈরী কিছুটা দামী এবং উন্নত মানের শাড়ী লুঙ্গি ক্রয় করে যাকাত গ্রহীতাদের মধ্যে বিতরণ করাটা যেন রীতিমত রেওয়াজ বিরোধী কেউ কেউ হয়তো শরীয়ত বিরোধী বলেও মনে করেন। বাজারের সব চাইতে সস্তা মূল্যের কাপড় কিনে যাকাত হিসেবে প্রদান করাটাই যেন এখন একটা অলিখিত বিধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ব্যতিক্রম কোন অবস্থাতেই যেন না হয় সেদিকে তারা কান খাড়া করে রাখেন।

আমাদের সমাজে অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে অস্বচ্ছল ব্যক্তিদেরকে তাদের এই অর্থনৈতিক দুরাবস্থা থেকে মুক্তি দানের জন্য সমাজের স্বচ্ছল বা ধনী ব্যক্তিদের উপর যাকাত ফরজ করা হয়েছে। সৃষ্টি কর্তার এই বিধান যারা লংঘন করে আসছেন তাদের কথা ভিন্ন কিন্তু এই আইনকে যারা মেনে চলেছেন তাদের একাংশই যাকাত আদায়ের এই ফরয এবাদতকে গরীবের প্রতি অনুগ্রহ বলে মনে করেন। ইসলামের মূল পাঁচটি স্তম্ভের একটি হলো যাকাত। যাকাত একটি ফরয এবাদত। এই ফরয এবাদত সর্বোত্তম এবাদতের অন্যতম। কিন্তু সর্বাধিক নিকৃষ্ট সূতায় তৈরী কাপড় যাকাত স্বরূপ বিতরণ করে সর্বোৎকৃষ্ট এবাদত কিভাবে আদায় হতে পারে তা আমার বোধগম্য হয়না। অনেকেই হয়তো বিশ্বাস করেন যাকাতের কাপড় যত বেশি সংখ্যক লোকদের দেয়া যাবে সওয়াবের সংখ্যাও বুঝি তত বেশি বাড়বে তাই হয়তো কাপড়ের গুণাগুনের বিষয়টি সরাসরি উপেক্ষিত হয়ে পড়ে এবং সংখ্যা বাড়ানো দিকেই যাকাত দাতা দৃষ্টি নিবন্ধন করে রাখেন। তার মানে এই নয় যে আমি বলতে চাচ্ছি যারাই যাকাত নিতে আসবে তাদের প্রত্যেককে একটা করে জামদানি শাড়ী আর সিঙ্গাপুরী লুঙ্গী দেয়া হোক।

কিন্তু যাকাত প্রদানের নামে মাইকিং করে পোষ্টারিং করে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে সর্ব নিকৃষ্ট মানের এসব কাপড় বিতরণ করা কতটুকু সমর্থনযোগ্য ? গরীব মিসকিনদের উন্নত মানের খাবার দিয়ে পরিতৃপ্ত করা নিঃসন্দেহে অশেষ পূণ্যের কাজ কিন্তু আমার গায়ে রীতিমত জ্বালা ধরে যখন শুনি বা পত্রিকার পাতায় "কাঙ্গালী ভোজ" এর খবর পাঠ করি। কি হীন মানসিকতা আমাদের! আমাদেরই সমাজের অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছলদের নাম দেয়া হয়েছে "কাঙ্গাল"। আমাদের সমাজের একাংশকে এভাবে উপহাস করার অধিকার তাদেরকে কে দিলো? এই অপমানসূচক নামকরণের প্রতিবাদও কেউ কখনো করেনি, আশ্চর্য! অথচ এই কাঙ্গালী ভোজ যিনি করান তিনি কিভাবে এতো টাকা পয়সার মালিক হলেন সে খোঁজ খবরও কেউ রাখেন না। ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান সত্য হলেও তাদেরকে নিয়ে উপহাস করার অধিকার নিশ্চয় কারোই নেই। তেমনি ভাবে যাকাতের কাপড়ও একটা উপহাসের নাম। আমাদের মানসিক নিম্নমূখীতাই আমাদের সামগ্রিক পতনের জন্য দায়ী।

কান টানলে যেমন মাথা আসে তেমনি আমার মতে যাকাতের কাপড় টানলে অবধারিতভাবে মৃত্যুর নিশানাও চলে আসে। যাদের চোখ কান খোলা আছে তারা নিশ্চয় ভালো করেই জানেন প্রতি বছরই যাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে ভীড়ের চাপে বা পদদলিত হয়ে যাকাত গ্রহীতারা মারা যাচ্ছেন। সাম্প্রতিক সময়ের কোন খবরই আমাদের আড়ালে নয় নানান মাধ্যমে আমরা কানে খবর চলে আসে। তবুও যাকাতের কাপড় গ্রহণ করতে গিয়ে এ পর্যন্ত যে কতজন প্রাণ হারিয়েছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান আমার কাছে নেই তবে এর সংখ্যা যে নেহায়েত কম নয় তা যে কেউ অনুমান করতে পারবেন অতীতে যাকাতের কাপড় গ্রহণ করতে গিয়ে প্রাণ সংহারের নিম্নোক্ত ঘটনাগুলো থেকে।
* ১৯৮০ সালের রমজান মাসে যাকাতের কাপড় সংগ্রহ করতে গিয়ে ঢাকার জুরাইনে শিশুসহ ১৩ জন পদদলিত ও ভীড়ের চাপে নিহত হয়।
* ১৯৮৩ সালের ৯ই জুলাই শনিবার সকাল ১১টার দিকে যাকাতের টাকা ও কাপড় গ্রহণ  করতে গিয়ে ৩টি শিশু গুরুতর ভাবে আহত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঈদ উপলক্ষে এই টাকা ও কাপড় বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। ভীড়ের মধ্যে প্রচন্ড চাপে এই দুর্ঘটনা ঘটে। শিশু তিনটির নাম নূর জামান (৬), ঝন্টু (৪) এবং আবুল কালাম (৪)।
* ১৯৮৭ সালের ২৩শে মে শনিবারের আরো একটি মর্মান্তিক ঘটনা। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ ঢাকার ক্যান্টনমেন্টের শিখা অনির্বাণের বিপরীতে একটি খোলা চত্বরে যাকাতের কাপড় বিলি করার সময় বিপুল সংখ্যক লোকের সমাগম হয়। এক পর্যায়ে জনগণ উচ্ছৃংখল হয়ে পড়লে আইন শৃংখলা বাহিনীর সাথে তারা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় ৪ ব্যক্তি নিহত হয় এবং আহত হয় আরো অনেকেই।
* ১৯৮৯ সালের ৫ই মে শুক্রবার সকালে চাঁদপুর শহরে যাকাতের কাপড় সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রচন্ড ভীড়ের মধ্যে যাকাত সংগ্রহকারীদের পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই ১৪ জন নিহত হয় এবং আহত হয় ৫০ জন।
* ১৯৯০ সালের ২৬শে এপ্রিল বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের ঢাকা ট্রাংক রোডের পাশে পাহাড়তলীস্থ আবুল বিড়ির ফ্যাক্টরীতে সবচে ভয়াবহ মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। যাকাতের কাপড় ও টাকা আনতে গিয়ে সেখানে প্রচন্ড ভিড় জমে। ভিড়ের চাপে পিষ্ট হয়ে শিশু ও মহিলাসহ ৩৫ জন নিহত ও প্রায় ২০০ জন আহত হন। নিহতদের মধ্যে ১৮ জন মহিলা, ১৫ জন শিশু ও  ২ জন বৃদ্ধ ছিলেন। আহতদের মধ্যে ৭৬ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেয়া হয়।
* ১৯৯১ সালের ১৩ই এপ্রিল শনিবার সকাল ১০টায় নওয়াবপুর রোডে যাকাতের কাপড় সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রচন্ড ভিড়ের সৃষ্টি হয়। অত্যাধিক ভিড়ের চাপে ঘটনাস্থলেই একজন পুরুষ ও একজন মহিলা নিহত হন এবং আহত হন কম পক্ষে ২৫ জন।

এতো গেলো আমার জানা মতে কয়েকটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা এর বাইরেও যাকাতের কাপড় আনতে গিয়ে অনেক অনেক দুর্ঘটনা খবর পড়ে আছে। তাই আমার মতে যাকাতের কাপড় প্রদান রীতিমত একটা মরণ ফাঁদে পরিণত হয়ে গেছে। যাকাত দাতাদের যাকাতের সংখ্যা থেকে লোক দেখানোর জন্য প্রচারণার সংখ্যাটা বেশি বলেই যাকাতের তুলনায় যাকাত গ্রহীতারা বেশি হয়ে পড়েন। তাই কাড়া-কাড়ি পড়ে যায় কার আগে কে নেবেন। এবাদত হচ্ছে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। তাই এবাদত কখনোই লোক দেখানো হতে পারেনা। কিন্তু যারা যাকাত প্রদান করার পেছনে আল্লাহর সন্তুষ্টি দিকে লক্ষ্য না রেখে বাহবা কুড়াতে চান তাদের এই হীন মানসিকতার পরিবর্তন হোক, সেই সাথে এই স্বল্প মূল্যের যাকাতের এক টুকরো কাপড় যেন কারো জীবনে মৃত্যুর পয়গাম নিয়ে না আসে এই প্রার্থনা করি।

জবরুল আলম সুমন
সিলেট।
২১শে আগষ্ট ২০১১ খৃষ্টাব্দ।

0 মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পোস্ট পুরাতন পোস্ট হোম

    আমার ব্লগে আপনাকে স্বাগতম

    নিজের লেখা দিয়ে নিজের মতো করে এই ব্লগটি সাজানোর চেষ্টা করেছি, আমার এই ব্লগটি যদি আপনাদের ভালো লাগে তবেই আমার এই শ্রম স্বার্থক হবে। ব্লগটি পরিদর্শন করার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

ব্লগটি আজ দেখা হয়েছে মোট

ইতিহাসের এই দিনে

Flickr Images

2014 © জবরুল আলম সুমন কর্তৃক. Blogger দ্বারা পরিচালিত.

এক ঝলকে আমি

আমার ফটো
নিজের সম্পর্কে বলার মত সঞ্চয় আমার নেই। নিজেকে স্বচ্ছ আয়নার মতই ভাবি, আমার প্রিয় বন্ধুরা যখন আমার সামনে এসে দাঁড়ায় আমি তখন তাদের প্রতিবিম্ব মাত্র। তাতেই আমার সুখ। গান শুনতে পছন্দ করি, পছন্দ করি লিখতে আর সময় সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ি অচেনা পৃথিবীটাকে চেনার জন্য।

এই ব্লগটি সন্ধান করুন


Recent Comments