ভয়

রাত আড়াই'টা কি তিনটা বাজে। চারদিকে নিরব নিস্তব্ধতা তারপরও এই নিরবতার ফাঁক ফোঁকর গলে হঠাৎ করেই শাঁই শাঁই করে দ্রুত বেগেই ছুটে যাচ্ছে দু একটা গাড়ি, মাঝে মাঝে করুন সুরে দু-একটা কুকুরের কান্নার আওয়াজ দূর থেকে ভেসে আসছে কিন্তু তা কানে লাগেনা খুব একটা। শহুরে শেয়ালগুলোও কখনো সখনো দল বেঁধে জানিয়ে দিচ্ছে তারাও ঘুমিয়ে নেই। অমাবস্যা না হলেও গাঢ় অন্ধকারের শীতের রাত, ছিটে ফোঁটা বাতাস নেই ঘরে কিংবা বাইরে। রাস্তায় সোডিয়ামের বাতিগুলো স্থির হয়ে জ্বলে আছে, নিয়ন বাতি গুলোও যে যার মতো করে নির্দেশানুসারে জ্বলছে নিভছে। ঘরের সবকটি দরজা-জানালা লাগিয়ে খুব মন দিয়ে ফেসবুকে এক বা একাধিক বন্ধুর সাথে চ্যাট করছেন কিংবা সিডি প্লেয়ারে হাল্কা মিউজিকে গান শুনতে শুনতে তৈরী হচ্ছেন ঘুমোতে যাবার জন্য অথবা বিছানায় শুয়ে ঘুমুতে যাবার আগে কিছু একটা ভাবছেন ঠিক এই সময়ে যদি দেখেন আপনার বন্ধ দরজার পর্দা কেঁপে উঠছে কোন কারণ ছাড়াই তাহলে নিশ্চয় মনের আনন্দে ধেই ধেই করে নেচে উঠবেন না, কিছুটা হলেও ভয়ে আঁৎকে উঠবেন।

আমি ঠিক অতটা ভয় পাইনি কারণ প্রায়ই আমার দরজা খোলা থেকে যায় ভুলেই। এমনও হয়েছে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার রুম থেকে বারান্দায় যাওয়ার দরজাটা খোলা, তার মানে গত রাতে আমি দরজা না লাগিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমি বিছানা থেকে নেমে দরজার কাছে এগিয়ে গেলাম দরজায় খিল দেবার জন্য ঠিক তক্ষনিই ভয়ে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা ঝড় বয়ে গেলো। দরজায় খিল দেয়াই ছিলো, বাইরে থেকে বাতাস এসে দরজার পর্দা কাঁপিয়ে দেয়ার কোন সুযোগ ছিলো না, তাহলে দরজার পর্দা কেঁপে উঠলো কেন? শীতের রাত বলে ফ্যান ট্যান বন্ধ, বাতাসের আর কোন উৎস আমার ঘরের মধ্যে নেই। আমার ঘরে কোন ভ্যান্টিলেটর নেই যে বাইরে থেকে বাতাস আসতে পারে তাছাড়া বাইরে কোন বাতাস নেই, সব কিছুই স্থির হয়ে আছে। আমি সত্যি ভয় পেতে থাকলাম। আর একবার ভয় পেতে থাকলে তা মাল্টিপ্লে হতেই থাকে। ব্যাপারটি পুরোটাই হ্যালুসিনেশন বলে নিজেকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছি কিন্তু কোন ভাবেই শান্ত হতে পারছিনা। আমি বিছানায় শুয়ে থাকলে আমার ঘরের বারান্দায় যাওয়ার দরজাটা আমার চোখের সামনে পড়ে। আগে কোনদিনই এমন হয়নি তাহলে আজ হলো কেন? ভাবতে না ভাবতেই ঠিক আরো একবার কেঁপে উঠলো এবং আগের চাইতে আরোও তীব্র ভাবে, আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে সুরা কালাম পড়তে শুরু করি, কিন্তু সাহস হয়না পাশের ঘর থেকে কাউকে ডেকে তোলার। বালিশের পাশে দুই দুইটা সেলফোন পড়ে আছে কিন্তু সাহসে কুলাচ্ছেনা ফোনটা তুলে কাউকে একটা কল করতে।

আমি যখন প্যারানরমাল কোন বিষয়ে ভয় পাই তখন অন্য কোন বিষয় নিয়ে ভাবতে থাকি নিজেকে স্থির করার জন্য। যখন কিছুটা হলেও ভয় কেটে যায় তখন ভয় পাওয়ার কারণের একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করি কিন্তু দরজার পর্দা কেন কেঁপে উঠলো তার কোন ব্যাখ্যা আমি দাঁড় করাতে পারছিনা। আবারো ভয় পেতে শুরু করি কারণ দরজার পর্দাটা ঠিক আরো একবার কেঁপে উঠলো। পায়ের কাছে ভাঁজ করা কাঁথাটি পড়ে আছে, আমি পা দিয়ে কাঁথাটি হাতের কাছে টেনে নিলাম তারপর কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। এবার যা হয় হোক আমি আর ওদিকে নেই... চোখ বন্ধ করে আছি আধা ঘন্টার উপর কিন্তু ঘুম আসছেনা এতটুকুও। কাঁথাটা মাথা থেকে একটু উঁচিয়ে ধরে চোখটা আবারো পর্দার দিকে সেট করলাম, না এবার আর কাঁপছেনা। দুই মিনিট... তিন মিনিট... পাঁচ মিনিট! নাহ আর কাঁপছেনা। যেন হারানো সাহস ফিরে পেলাম। ভয় পুরোপুরি কাটেনি তবে কমে গেছে অনেক খানি তবুও ঘুম আসছেনা কোন ভাবেই। বালিশের পাশ থেকে এবার সেলফোনটা হাতে নিই। কোন কারণে বা অকারণে শুয়ে থাকার পরও যখন আমার ঘুম আসেনা তখন মোবাইল ফোন দিয়ে চুপি চুপি ফেসবুকে ঢুকে দেখি কে কি করছে কিন্তু কাউকে জানাই না যে আমিও আছি ফেসবুকে, কখনো বিভিন্ন ব্লগ বা নিউজ সাইটেও চক্কর দিই। টি-টুয়েন্টি নামের মজাদার একটা ক্রিকেট গেম আছে সেটাও কখনো খেলতে থাকি, একসময় মুঠোফোন মুঠোর মধ্যেই থেকে যায়, আমি ঘুমিয়ে পড়ি।

ফেসবুকও নীরব হয়ে আছে কাউকে দেখা যাচ্ছেনা, আমি ফেসবুক থেকে বেরিয়ে যাই। এবার না হয় খবরের কোন সাইটে ঢুকা যাক নিশ্চয় ভালো কোন খবর পড়ে আছে, যা পড়লে মনটা ভালো হয়ে যাবে। পড়তে পড়তে হাই তুলবো, হাই তুলতে তুলতে রাতকে বিদায় জানাবো। আমার মোবাইলে প্রথম আলোর একটা এপ্লিকেশান আছে, যার মাধ্যমে লিড নিউজগুলো পড়তে পারি সহজেই। আমি সেই এ্যাপ্লিকেশানের মাধ্যমে প্রথম আলোর সাইটে ঢুকলাম। আমার চক্ষু যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসছে, কি পড়ছি আমি? এটা কি সত্যি? চট্টগ্রামে উড়াল সড়কের (ফ্লাইওভার) গার্ডার ভেঙ্গে ১৩ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা গেছে যদিও স্থানীয়দের দাবী মৃতের সংখ্যা শতাধিক হতে পারে। কিন্তু কি এক অজানা কারণে মৃত ব্যক্তিদের সঠিক সংখ্যা গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হচ্ছেনা। এই উড়াল সড়কের নীচ দিয়ে প্রতিদিন সহস্রাধিক মানুষ যাতায়াত করে, শতাধিক কাঁচা মালের ব্যবসায়ীরা তাদের দোকানের পসরা সাজিয়ে বেচা কেনা করে। সেকারণেই মৃতের সংখ্যা মাত্র ১৩জন তা কোন ভাবেই মেনে নেয়া যায়না, সেনাবাহিনীর লোকেরা ঘটনাস্থল ঘিরে রেখেছে তাই সঠিক সংখ্যাও বের করা সাধারণের জন্য মুশকিল হয়ে পড়েছে। দূর্ঘটনা ঘটতেই পারে কিন্তু মৃতের সংখ্যা নিয়ে প্রশাসন বা গণমাধ্যম কেন লুকোচুরি খেলছে তা আমার মাথায় ঢুকছেনা এই মুহুর্তে। বুকটা ধ্বক ধ্বক করতে শুরু করলো কি হচ্ছে এসব? আমি এবার খবরের দ্বিতীয় শিরোনামে চোখ রাখি। দ্বিতীয় শিরোনামটা আরোও ভয়াবহ। ঢাকার অদূরে আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ১১৫জন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ১২৪ জনে দাড়িয়েছে উদ্ধার তৎপরতা অব্যাহত আছে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত লাশের সংখ্যা আরোও বাড়তে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে।

আমি শুয়ে থাকা অবস্থা থেকে উঠে বসে পড়লাম। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। পাশে থাকা পানির বোতল থেকে কয়েক ঢোক পানি গিলে গলাটা ভিজিয়ে নিলাম। ভাবার শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের জীবনটা কি এতোই সস্তা হয়ে গেছে? প্রতিদিনের খবরের শিরোনামে কেন উঠে আসবে আজ অমুক জায়গাতে সড়ক দূর্ঘটনায়, লঞ্চ ডুবিতে, নির্মাণাধীন বিল্ডিংয়ের ছাদ ধ্বসে, পাহাড় ধ্বসে, অগ্নিকান্ডে বা নানাবিধ দূর্ঘটনায় এতো জন মারা গেছেন বা এতো জন আহত হয়ে হাসপাতালের বেডে কাতরাতচ্ছেন মারা যাবেন বলে। আবারো আমার দরজার পর্দাটি কেঁপে উঠলো এবার আর আমি একটুও ভয় পেলাম না। সাহস করে বিছানা থেকে নেমে গেলাম। অপেক্ষা করছি আরো একবার কেঁপে উঠে কিনা। হ্যাঁ আবারো কেঁপে উঠলো আমি সাথে সাথে দরজার পর্দা ধরে টান দিলাম তখনি আসল রহস্য বেরিয়ে আসলো। কোন এক ফাঁকে একটা নেংটি ইঁদুর আমার ঘরে ঢুকে পড়েছিলো কিন্তু আমার ঘর থেকে অন্য কোন ঘরে যাওয়ার কোন পথ না পেয়ে পর্দার ওপাশে নেংটি ইঁদুরটি বার বার দরজার পর্দা বেয়ে উঠা নামা করছিলো বলে বার বার পর্দা কেঁপে উঠছিলো। রহস্য ভেদ করতেই আমার পর্দা বিষয়ক ভয় পুরোপুরি কেটে যায়।

আমার ভয় কেটে গেলেও কি তাদের ভয় কাটবে কোন ভাবেই? যারা উড়ালসড়ক দূর্ঘটনায় তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম প্রিয় মানুষটিকে হারিয়েছেন বা আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনের অগ্নিকান্ডে প্রিয় মুখ পুড়ে ছাই হয়েছে? উল্লেখিত দূর্ঘটনায় প্রশাসন বা গণমাধ্যমের রহস্যজনক আচরণে কতজন মানুষ নির্ভয়ে থাকতে পারবেন? সাধারণ মানুষেরা হয়তো বিক্ষিপ্ত ভাবে দু একটা মিছিল, প্রতিবাদ সভা আর মানববন্ধন করে দু-দিন পরে সব ভুলে যাবে। বুদ্ধিজীবিরা টেলিভিশনের টক শো-তে এসে আলোচনা সমালোচনার ঝড় তুলবেন। বিভিন্ন গণমাধ্যম কয়েকদিন ধারাবাহিক খবর প্রচার করে থেমে যাবে একদিন। প্রশাসনও সত্য মিথ্যা মিলিয়ে তদন্ত করে নীরব হয়ে যাবে যেমন করে নীরব হয়ে যায়। দায়ী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিরাও আইনের ফাঁক ফোঁকর গলে একদিন বেরিয়ে আসবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল হয়তো এই দূর্ঘটনাকে একটা ইস্যু তৈরী করে কয়েকটা গাড়ি ভাংচুর করে হরতাল অবরোধ করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটবে। সরকার বা সরকারী দল দূর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারেকে দু একটা ছাগল বা পাঠা দান করে টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে পোজ দিয়ে বাকি দায়িত্ব এড়িয়ে যাবেন কিন্তু উল্লেখিত দূর্ঘটনায় নিহতদের পরিবার যারা তাদের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি হারিয়েছে তাদেরকে কে অভয় দেবে? কে নিশ্চয়তা দেবে একমুঠো খাবারের? কে বা কারা তাদের পাশে গিয়ে বলবে, কেঁদোনা, ভয় পেয়োনা, আমরা আছি তোমাদের পাশে, তোমাদের প্রাত্যহিক আহারের পাতে খাবার তুলে দিতে...

জবরুল আলম সুমন
সিলেট।
২৫শে নভেম্বর ২০১২ খৃষ্টাব্দ।

0 মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পোস্ট পুরাতন পোস্ট হোম

    আমার ব্লগে আপনাকে স্বাগতম

    নিজের লেখা দিয়ে নিজের মতো করে এই ব্লগটি সাজানোর চেষ্টা করেছি, আমার এই ব্লগটি যদি আপনাদের ভালো লাগে তবেই আমার এই শ্রম স্বার্থক হবে। ব্লগটি পরিদর্শন করার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

ব্লগটি আজ দেখা হয়েছে মোট

ইতিহাসের এই দিনে

Flickr Images

2014 © জবরুল আলম সুমন কর্তৃক. Blogger দ্বারা পরিচালিত.

এক ঝলকে আমি

আমার ফটো
নিজের সম্পর্কে বলার মত সঞ্চয় আমার নেই। নিজেকে স্বচ্ছ আয়নার মতই ভাবি, আমার প্রিয় বন্ধুরা যখন আমার সামনে এসে দাঁড়ায় আমি তখন তাদের প্রতিবিম্ব মাত্র। তাতেই আমার সুখ। গান শুনতে পছন্দ করি, পছন্দ করি লিখতে আর সময় সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ি অচেনা পৃথিবীটাকে চেনার জন্য।

এই ব্লগটি সন্ধান করুন


Recent Comments